সারা বাংলা

সৈকতে বাড়ছে অপমৃত্যু, দুর্ঘটনা

করোনার প্রকোপ কমায় দীর্ঘ ৪ মাস ১৯ দিন পর কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত খুলে দেয়া হলে পর্যটক আসতে শুরু করে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে।

অনেকদিন সমুদ্রস্নান ও বালিয়াড়িতে খেলার আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকা পর্যটকরা এবার মাত্রাতিরিক্ত আনন্দ, হৈ-হুল্লোড়ে পুষিয়ে নিচ্ছেন বিগত দিনগুলি। মনের আনন্দে বেড়াচ্ছেন এদিক-ওদিক। ওয়াটর বাইক, স্পীডবোট ও সাতাঁরো টায়ারে চড়ে বল্গাহারা হুল্লোড়ে মেতেছেন অনেকে। তবে এই বেড়ানোর আনন্দ বিষাদে রূপ নিচ্ছে সৈকতে বাড়তে থাকা অপমৃত্যু ও নানান দুর্ঘটনার কারণে।

গত এক সপ্তাহে সৈকতে নেমে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। হোটেলে উঠে অতিরিক্ত মদপানে আরেক পর্যটকের মৃত্যু এবং শখের প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে নারী পর্যটক মারত্মক আহত হয়েছেন।  এসব অপমৃত্যু ও দুঘর্টনায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সচেতন মহল। পর্যটন সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব ও নজরদারিকে আরো গুরুত্ব সহকারে দেখছেন তারা। তবে পর্যটকদের অসাবধনতা ও লাইফগার্ডের দেয়া নির্দেশনা যথা- জোয়ার-ভাটার সময়সূচি, হুশিয়ারি বাঁশি, বিভিন্ন সংকেত ও লাল পতাকার সংকেত অমান্য করাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত ৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে তৌনিক মকবুলের (২৩) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি ব্রাক ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তৌনিক ঢাকার শ্যামলীর আদাবর এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলামের ছেলে।

১৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার সময় দরিয়া নগর এলাকায় নিয়ম ভেঙে সন্ধ্যায় প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে ঢাকার খিলক্ষেত এলাকার তারিকুল ইসলামের স্ত্রী তিন্নি আক্তার (২৬) মারাত্মক আহত হন। নিয়ম হচ্ছে প্যারাসেইলিংয়ের শেষ সময় বিকেল ৩টা পর্যন্ত। এই নিয়ম করে জেলা প্রশাসন সৈকতের পয়েন্ট নির্ধারণ করে বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু সেই নিয়ম ভেঙে ৫ মিনিটে ২ হাজার টাকা করে লোভে সন্ধ্যা হয়ে গেলেও প্যারাসেইলিং চালু রাখা হয়। সন্ধ্যার অন্ধকারে ঠিকমতো ঠাওর করতে না পেরে ভুল ল্যান্ডিংয়ে পায়ে মারাত্মক চোট পান তিন্নি আক্তার। কক্সবাজার বেড়ানো মাঝপথে বন্ধ করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা ফিরে যান তিনি।

১৭ সেপ্টেম্বর দুই থেকে আড়াই ঘন্টার ব্যবধানে সমুদ্র থেকে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দুপুর ১টায় সীগাল পয়েন্টে ভেসে আসে ১৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইমন নামের কিশোরের লাশ। এর দুই ঘন্টা পর একই পয়েন্টে বিকেল ৩টায় উদ্ধার হয় আরও এক অজ্ঞাত যুবকের লাশ। ওইদিন সকালে হোটেলে চট্টগ্রাম কোতোয়ালী থানার সৈয়দুল হকের ছেলে রাফসানুল হক (৩২) নামের এক পর্যটকের অতিরিক্ত মদপানে মুত্যু হয়।

গত এক সপ্তাহে পানিতে ডুবে ৩ জনের মৃত্যু, অতিরিক্ত মদপানে ১জনের মৃত্যু আর প্যারাসেইলিং থেকে ছিটকে ১ জন আহতসহ ছোট-বড় নানা দুর্ঘটনা ঘটছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে।

এ ব্যাপারে সী সেইফ প্রোগ্রাম ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সমুদ্রসৈকতের পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে সমুদ্রের অবস্থা যেরকম ছিল এখন ঠিক সেরকম নেই। প্রাকৃতিক নিয়মে সাগরের তলদেশ দিন দিন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। সাগরে এখন বড় বড় গুপ্তখালের সৃষ্টি হচ্ছে। এটি একটি পরিবেশগত কারণ। এছাড়া আগে এক জায়গার মধ্যে অনেক মানুষ দেখা যেত, কিন্তু এখন সমুদ্রসৈকত সোজা হয়ে যাওয়ায় মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা সমুদ্রসৈকত সোজা কিংবা প্রসার পেয়ে অনেকদূর পর্যন্ত চলে যায়। লাইফগার্ডের সংকেত মানে না। লাল পতাকা দিলেও তারা সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পানিতে নেমে গোসল করে। সৈকতে আমাদের লাইফগার্ড কর্মী আছে মাত্র ২৭ জন। সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে আসা এতোগুলো মানুষকে অল্প সংখ্যক লাইফগার্ড কর্মী দিয়ে নজরদারি রাখাটা খুব জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া আমাদের সংগঠনের অর্থনৈতিক সংকটে আমরা আরো বেশি লাইফগার্ড নিয়োগ দিতে পারছি না। এই ডিসেম্বরেই প্রজেক্ট শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মূলত লাইফগার্ড কম থাকায় অনাকাঙ্খিত ঘটনা গুলো ঘটছে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমদের লাইফগার্ড কর্মীরা সবসময় সজাগ ও সচেতন। সার্বক্ষণিক পর্যটকের সেবায় নিয়েজিত তারা। সমুদ্রসৈকত খুলে দেয়ার পর থেকে সী সেইফ লাইফগার্ড পানিতে ভেসে যাওয়া ৩১৫ জনকে রক্ষা করেছে। আমরা পর্যটকের সেবা নিশ্চিতে সবসময় আন্তরিক ও প্রস্তুত রয়েছি।’

এদিকে, শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে সমুদ্র সচেতনায় ১০ দিনের ক্যাম্পেইনের উদ্বোধন করেছেন জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ। ‘সতর্কতাই নিরাপত্তার পূর্বশর্ত’ এই প্রতিপাদ্যে সমুদ্রের পানিতে নামার আগে করণীয় ও সতর্কতার ব্যাপারে সচেতনতামূলক বক্তব্য রাখেন তিনি।

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সমুদ্রের পানিতে নামার আগে কিছু সতর্ক বার্তা এই ১০ দিন আমরা প্রচার করতে চাই।  পর্যটক যারা আসবেন তাদের তো জানা নেই যে এখানে লাইফগার্ড আছে। এখানে  সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে।  কোন চিহ্ন দিয়ে কি অর্থ প্রকাশ পায়, লাল পতাকার অর্থ কীÑ সেগুলোর বর্ণনা আছে।  আত্মীয়-স্বজন, পরিবার পরিজন নিয়ে যারা কক্সবাজার সৈকতে বেড়াতে আসেন তারা অনেক সময় সিগনালগুলো খেয়াল করতে পারে না। তাদের অবগতির জন্য এই আয়োজন করা হয়েছে। তাদের সহায়তার জন্য এখানকার বিচকর্মীরা সার্বক্ষণিক সজাগ রয়েছেন।’

ওইদিন জেলা প্রশাসক জানান, আগামী দশ দিন পর্যন্ত কলাতলী, সুগন্ধা এবং লাবণী বিশেষ করে এই তিনটা পয়েন্টে এরকম প্রচার অভিযান চালানো হবে। এখন থেকে পর্যটকরা সমুদ্রস্নান কিংবা পানিতে নামার আগে প্রশাসনের দেওয়া নির্দেশনা ও সময়সূচি মেনে সমুদ্র সৈকতে নামবেন। এসময় তিনি পর্যটকদের সহযোগিতার আহ্বান জানান।

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে নামার আগে পর্যটকদের ১০টি নির্দেশনা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। সেগুলো হলো-

১. সাঁতার না জানলে সমুদ্রের পানিতে নামার সময় লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করতে হবে।  ২. লাল পতাকায় চিহ্নিত করা পয়েন্টে কোনোভাবে নামা যাবে না।  ৩. সৈকত এলাকায় সবসময় লাইফগার্ডের নির্দেশনা মানতে হবে।  ৪. বিকেল ৫টার পর সমুদ্রে নামা যাবে না।  ৫. সমুদ্রে নামার আগে জোয়ার-ভাটাসহ আবাহাওয়ার বর্তমান অবস্থা জেনে নিতে হবে। ৬. লাইফগার্ড নির্দেশিত নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্যকোনো পয়েন্ট থেকে সমুদ্রে নামা যাবে না। ৭. সমুদ্রে যেকোনো মুহূর্তে তীব্র স্রোত এবং গর্ত সৃষ্টির বিষয়ে জানতে হবে। ৮. যেকোনো ভাসমান বস্তু নিয়ে পানিতে নামার আগে বাতাসের গতি সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। ৯. শিশুকে সৈকতে সব সময় সঙ্গে রাখতে হবে এবং তাকে একা সমুদ্রে নামতে দেওয়া যাবে না। ১০. অসুস্থ অথবা দুর্বল শরীর নিয়ে শরীর নিয়ে সমুদ্রে হাঁটু পানির বেশি নামা যাবে না।