সারা বাংলা

মাছের ঘের নেই, তবুও করোনার প্রণোদনা

মাছের ঘের নেই, তবুও মিলেছে করোনার সরকারি প্রণোদনা। মাছের চাষ না করেও এক পাড়ায় ২৫ জন প্রণোদনার টাকা পেয়েছেন। 

অভিযোগ উঠেছে, এরা অর্থ পেয়েছে এনএটিপি প্রোজেক্ট-২ এর তালা মৎস্য অফিসের ক্ষেত্র সহকারির আত্মীয় ও বন্ধু বিবেচনায়। অথচ করোনায় বিপর্যস্ত প্রকৃত মৎস্য চাষিদের বড় অংশই টাকা পায়নি বলে জানা গেছে। 

করোনাকালে সাসটেইনেবল কোষ্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের প্রণোদনায় সাতক্ষীরার তালাসহ বেশ কয়েকটি উপজেলায় এমন সব কাণ্ড হয়েছে অভিযোগ পাওয়া গেছে।  এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে-প্রধানমন্ত্রীর অগ্রধিকার প্রকল্পে এমন অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

জেলা মৎস্য বিভাগ থেকে জানা গেছে, সাতক্ষীরা জেলার বেশির ভাগ মানুষ মৎস্য চাষে নির্ভরশীল। জেলায় ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে ৬৬ হাজার ৮১৪টি গলদা ও বাগদা চিংড়ি ঘের রয়েছে। করোনাকালিন সময়ে এসব ঘেরের মৎস্য চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অগ্রধিকার প্রকল্প সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় সরকার প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। সাতক্ষীরার সাত উপজেলায় ২০ হাজার মৎস্য চাষিদের নামের তালিকা তৈরি করে মৎস্য বিভাগ। 

ন্যাশনাল এগ্রিকালচার টেকনোলজি (এনএটিপি) প্রোজেক্ট-২ কর্মীদের দিয়ে তালা উপজেলা ২ হাজার ৭৪৫ জন মৎস্য চাষিদের তালিকা করা হয়। তার মধ্যে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম পর্যায়ে আড়াই হাজার চাষির ১৩ থেকে ১৮ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বাকি চাষিদের আগস্ট মাসের ২৭ তারিখ থেকে ১০ হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ ১৩ হাজার টাকা নগদ, বিকাশ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রদান করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। 

সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের একটি সূত্র জানায়, জেলার সাত উপজেলায় এই প্রকল্পের প্রণোদনায় ২০ হাজার ৭৪৫ জন মৎস্য চাষির মধ্যে ২৯ কোটি ৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ১ হাজার ১৮৭ জন মৎস্য চাষির মধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখ ৩৬ হাজার টাকা, তালা উপজেলায় ২ হাজার ৯৬৭ জন চাষির মধ্যে ৪ কোটি ২ লাখ ৫৪ হাজার টাকা, কলারোয়া উপজেলায় ৫২৭ জন চাষির মধ্যে ৬০ লাখ ৮০ হাজার টাকা, দেবহাটা উপজেলায় ১ হাজার ৭১২ জন চাষির মধ্যে ২ কোটি ৭৭ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, কালিগঞ্জ উপজেলায় ৫ হাজার ৩৭২ জন চাষির মধ্যে ৭ কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা, আশাশুনি উপজেলায় ৪ হাজার ১৮৪ জন চাষির মধ্যে ৫ কোটি ৬৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকা, ও শ্যামনগর উপজেলায় ৪ হাজার ৮০১ জন চাষির মধ্যে ৬ কোটি ৭৯ লাখ ১৬ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। 

মৎস্য অফিসের বিতর্কিত তালিকায় করোনায় বিপর্যস্ত প্রকৃত মৎস্য চাষিদের বড় অংশই স্থান পায়নি। অভিযোগ উঠেছে, তালা উপজেলার জালালপুর শাখারিপাড়ায় মাছের ঘের না করেও সরকারি প্রণোদনা পেয়েছেন একই পরিবারের ৪ সদস্য, কোন পরিবারে বাবা ও ছেলে, দুই ভাইসহ সরকারি চাকরিজীবী, চাউল, পান ও জুয়েলারি ব্যবসায়ীসহ প্রায় ২৫ জন। 

কমিশন নিয়ে সরকারি প্রনোদনার টাকা পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন খোদ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ও ন্যাশনাল এগ্রিকালচার টেকনোলজি (এনএটিপি) প্রোজেক্ট-২ এর তালা মৎস্য অফিসের ক্ষেত্র সহকারি শিবাশীষ বৈরাগী। 

উপজেলার বেশিরভাগ ঘের মালিকরা বলছেন, তারা টাকা পাননি। আর টাকা পাওয়া ভূয়া মৎস্য চাষিরা ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হয়নি। 

তালা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম. মফিদুল হক লিটু ও খলিলনগর,ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মো.আজিজুল ইসলাম রাজু জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে সমন্বয় করে প্রকৃত ঘের মালিকদের তালিকা তৈরি করার কথা থাকলেও মৎস্য বিভাগ নিজেদের ইচ্ছামত তালিকা করে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এর সুস্ঠু তদন্তেরও দাবি জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। 

তালা উপজেলার জালালপুর শাখারি পাড়া ও তার আশে পাশে মৎস্য বিভাগের করোনার সরকারি প্রণোদনা পেয়েছেন তারা হলেন- তালিকা অনুযায়ি একই পরিবারের রবীন্দ্রনাথ সেন পেয়েছেন ১৩ হাজার টাকা, ছেলে মনোজ সেন পেয়েছেন ১৩ হাজার টাকা, একই পরিবারে হরসিত সেন পেয়েছেন ১৩ হাজার টাকা, ছেলে সাগর সেন পেয়েছেন ১৩ হাজার টাকা, অমিত সেন-১ পেয়েছেন ১৩ হাজার টাকা, অমিত সেন-২ পেয়েছেন ১৩ হাজার টাকা, একই পরিবারে দুই ভাই শুভশীষ পাল পেয়েছেন ১০ হাজার টাকা, দেবাশীষ পাল পেয়েছেন ১৩ হাজার টাকা, দুই ভাই স্বপন ঘোষ পেয়েছেন ১৩ হাজার টাকা, তাপস ঘোষ পেয়েছেন ১৩ হাজার টাকা, সুজন কুমার পেয়েছে ১০ হাজার টাকা, বিজয় সেন পেয়েছেন ১৮ হাজার টাকা, সুজিত দত্ত পেয়েছেন ১০ হাজার টাকা। একইভাবে অমিত কুমার, সংকর সেন, শুভ দত্ত, সুজিত দত্ত, মৃত্যুঞ্জয়-১, মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ, সুমন ভদ্র, দিপু ধর, শিফালি খাতুনসহ প্রায় ৩০ জন টাকা পেয়েছেন।    টাকা পাওয়া একাধিক ব্যক্তি জানান, মনোজ সেন পরিবারের ৪ জন সদস্য টাকা পেয়েছে। এর মধ্যে তালিকায় মুসলিম সম্প্রদায়ের নাম দিয়ে মনোজ সেনের দুই বোন টাকা উত্তোলন করেছে তার প্রমাণ তালা উপজেলা মৎস্য বিভাগের টাকা বিতরনকৃত তালিকায় রয়েছে। 

শিবাশীষ বৈরাগী জানান, জালালপুর শাখারি পাড়ায় মৎস্য ঘের নেই এমন কোন ব্যক্তির তালিকা আমি করিনি।  তারা কিভাবে টাকা পেয়েছে আমি জানি না। মনোজ সেন নামে আমার কোন বন্ধু নেই। 

তালা উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা স্নিগ্ধা খাঁ বাবলী অনিয়ম হয়নি দাবি করে বলেন, অফিসে তালিকা জমা নেওয়ার কোন সুযোগ নেই-ঘেরের দাগ নম্বর ও লোকেশন বেজ করে তালিকা তৈরি করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, জালালপুর শাখারি পাড়া এলাকায় যাদের মৎস্য ঘের নেই এমন ৩০ জন টাকা পেয়েছেন বলে একটি অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। অফিসের কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান জানান, প্রধানমন্ত্রীর অগ্রধিকার প্রকল্প সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় সরকার প্রণোদনা প্রদানের ঘোষণা দেয়। সেই অনুযায়ী জেলার সাত উপজেলার ২০ হাজার ৭৪৫ জন মৎস্য চাষির মধ্যে ২৯ কোটি ৪ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। 

তিনি জানান, তালা উপজেলায় সম্প্রতি মৎস্য চাষিদের সরকারি প্রণোদনার তালিকা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে, তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।