সারা বাংলা

৬ বছর পর শম্পা হত্যার রহস্য উদঘাটন

৬ বছর আগে ২০১৫ সালের ৩ মে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিলো বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। একই দিন সন্ধ্যার দিকে লাশ পাওয়া গিয়েছিলো ঢাকায়। 

দীর্ঘ ৪ বছর তদন্ত করেও লাশের পরিচয় ও হত্যাকাণ্ডের স্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হয়নি কিন্তু পুলিশ ও সিআইডি টিম।  শেষ পর্যন্ত এই মামলায় আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হলেও আদালত ফাইনাল রিপোর্ট গ্রহণ না করে পিবিআইকে মামলাটি পুনরায় তদন্তের আদেশ দেন। 

পিবিআই ২ বছর তদন্ত করে একটি জিডির সূত্র ধরে লাশের পরিচয়, হত্যা রহস্য উন্মোচন এবং খুনিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে শনিবার (২৫ সেপ্টেম্বর)। 

পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জানান, তৎকালীন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা রেজাউল করিমের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো স্বাস্থ্য সহকারী শম্পা বেগমের। দীর্ঘ প্রেমের সূত্রে শম্পাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক সাথে বেশ কিছুদিন বসবাস করলেও বিয়ে না করায় দুই জনের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। এর জের ধরেই ২০১৫ সালের ৩ মে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানার আওতাধীন একটি বাসায় শম্পা বেগমকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে রেজাউল করিম। একই দিন সকালে শম্পার লাশ একটি ট্রাংকটি তালাবদ্ধ করে ঢাকাগামি ইগল পরিবহনের একটি বাসে তুলে দেয় ঘাতক। মালিকবিহীন এই ট্রাংকটি ঢাকায় পৌঁছার পর পুলিশ ট্রাংক থেকে নারীর লাশ উদ্ধার করে। 

পিবিআই জানায়, সে সময় পুলিশ লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠায়। পরে নাম-পরিচয় খুঁজে না পাওয়ায় অজ্ঞাতনামা হিসেবে লাশটি দাফন করা হয়। এই ঘটনায় দারুস সালাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহানুর আলী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা উল্লেখ করে ২০১৫ সালের ৩ মে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি দারুস সালাম থানা পুলিশ তিন মাস তদন্ত করে। পরে তদন্তভার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দেওয়া হয়। চার বছর তদন্ত করে সিআইডি। কিন্তু লাশের পরিচয় শনাক্ত এবং হত্যা রহস্য কোনোটাই উদঘাটন করতে না পেরে মামলাটির চূড়ান্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করে সিআইডি। কিন্তু আদালক চুড়ান্ত রিপোর্ট গ্রহণ না করে মামলা তদন্তে পিবিআইকে দায়িত্ব প্রদান করে।

পিবিআই ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে কাজ শুরু করে। পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) ইউনিটের তদন্তকারী কর্মকর্তারা অজ্ঞাত নারীর পরিচয় শনাক্ত করতে সব ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এরপর চট্টগ্রাম শহর ও জেলা এলাকার সব থানায় ২০১৫ সালে নিখোঁজ জিডির অনুসন্ধান শুরু হয়। সেখানে ১০-১২টি নিখোঁজ জিডির তথ্য উদঘাটন করা হয়। জিডিগুলোর মধ্যে ২০১৫ সালের ১০ জুন তারিখের একটি জিডিতে (নং ৫৯৯) দেখা যায়, শম্পা বেগম চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। ওই ঘটনায় নিহত শম্পা বেগমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান পাহাড়তলী থানায় জিডিটি করেন।

ওই জিডির সূত্র ধরে তদন্তকারী কর্মকর্তা জিডিকারী আব্দুল মান্নান ও নিহত শম্পার বাবা ইলিয়াস শেখের (অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য) সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, ২০১৩ সালে রেজাউল করিম স্বপন (অবসরপ্রাপ্ত নৌ বাহিনী সদস্য) খুলনা তিতুমীর নৌ ঘাঁটিতে কর্মরত থাকাকালীন শম্পা বেগম একটি হাসপাতালে মেডিক্যাল অ্যাসিস্টেন্টের কাজ করতেন। ওই হাসপাতালে ইলিয়াস শেখের স্ত্রীর চিকিৎসার সুবাদে শম্পার সঙ্গে রেজাউলের পরিচয় হয়। পরিচয়ের এক পর্যায়ে প্রেম হয়। পরে শম্পা বিয়ের জন্য চাপ দিলে রেজাউল বদলি হয়ে চট্টগ্রামে চলে আসেন। শম্পাও কিছুদিন পর চট্টগ্রামে তার এক ফুফুর বাসায় চলে আসেন। এরপর ফয়’স লেক এলাকায় একটি হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করেন তারা। তারপর পাহাড়তলী থানাধীন একটি আবাসিক এলাকায় একটি টিনশেড বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে সাবলেট হিসেবে বসবাস শুরু করেন দুজনে। এভাবে তারা ২০১৪-২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত বসবাস করেন। দুজনে বিয়ে না করলেও পরিবারকে জানান তারা বিয়ে করেছেন। 

জিডি’র সূত্র ধরে শম্পার পরিচয় শনাক্ত এবং পরিবারের কাছ থেকে ঘটনার পূর্বাপর ঘটনা জানার পর শনিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) কুমিল্লার একটি ভাড়া বাসা থেকে সাবেক নৌবাহিনীর কর্মকর্তা রেজাউল করিমকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। 

গ্রেপ্তারের পর পিবিআই’র জিজ্ঞাসাবাদে রেজাউল করিম জানায়, ২০১৫ সালের ২ মে গভীর রাতে মনোমালিন্য হলে শম্পাকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন তিনি। এরপর লাশ গোপন করতে একটি ট্রাংকে ভরে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের বাসে তুলে দেন। শম্পার বাবাকে তিনি জানান, শম্পাকে খুলনার বাসে তুলে দেওয়া হয়েছে। বাসে তুলে দেওয়ার পর দুদিন টিভি-পত্রিকা মনিটর করেন রেজাউল করিম। কিন্তু কোথাও সেভাবে কোনো সংবাদ না আসায় তিনি নিশ্চিত হন, এটা নিয়ে আর কোনো ঝামেলা হবে না।

এদিকে শম্পা বাড়ি না পৌঁছায় বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। শম্পার পরিবারের পাশাপাশি খোঁজ করতে থাকেন ঘাতক নিজেও। না পেয়ে পাহাড়তলী থানায় একটি জিডি করেন শম্পার ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান। শম্পার বাবা ২০১৫ সালের ২৭ মে রেজাউল করিম স্বপনের বিরুদ্ধে নৌবাহিনী চট্টগ্রাম অফিসে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাহিনী তদন্ত করে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে ২০১৯ সালে তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়। এরপর তিনি কুমিল্লায় বসবাস করছিলেন। তবে তার শেষ রক্ষা হয়নি। পিবিআই তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করেছে। এর মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছে ৬ বছর আগে অজ্ঞাতনামা হিসেবে উদ্ধার হওয়া এক নারীর হত্যা রহস্য।