সারা বাংলা

করোনাকালে টাঙ্গাইলে ১২৪২ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে

করোনাভাইরাসের কারণে দেড় বছরের বেশি সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে দুই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া টাঙ্গাইলের প্রায় প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। দারিদ্রতা, পারিবারিক ও সামাজিক অসচেতনার কারণে এসব বাল্য বিয়ে হয়েছে বলে জানিয়েছে অভিভাবক ও জন প্রতিনিধিরা।

করোনায় টাঙ্গোইলে অন্তত কয়েক হাজার ছাত্রী বাল্যবিয়ে হলেও স্থানীয় শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী জেলায় ১ হাজার ২৪২ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন।  যাদের মধ্যে অনেকেই বিয়ের পরেও নিয়মিত ক্লাস করছে।

জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র সোমবার (২৭ সেপ্টেম্বর) জানায়, টাঙ্গাইলে ৭৯৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজ রয়েছে। জেলার ১২টি উপজেলায় করোনাকালে ১ হাজার ২৪২ জন শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন।  এর মধ্যে টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় ৮৮ জন, সখিপুরে ১৪৩ জন, ঘাটাইলে ৪৯ জন, গোপালপুরে ৫৬ জন, ভূঞাপুরে ১৪ জন, কালিহাতীতে ২২৯ জন, দেলদুয়ারে ২২৮ জন, বাসাইলে ৪৪ জন, নাগরপুরে ১১৪ জন, মির্জাপুরে ৬ জন, মধুপুরে ১১৮ জন, ধনবাড়ীতে ১৫৩ জন।

শিক্ষা অফিস তথ্য অনুয়ায়ী সদর উপজেলায় ৮৮ জন বাল্যবিয়ের শিকার দেখানো হয়েছে।  কিন্তু এ উপজেলার চরাঞ্চলের হুগড়া হাবিব কাদের উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬০ জন ছাত্রী, মগড়া উচ্চ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩০ জন, পাকুল্যা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২২ জন, চৌধুরী মালঞ্চ উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৫ জন, খাস কাকুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৩ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে।  

অপরদিকে শিক্ষা অফিস ভূঞাপুর উপজেলায় বাল্যবিয়ের শিকার ১৪ জন দেখানো হয়েছে। কিন্তু এ উপজেলার চরাঞ্চল গাবসারা ইউনিয়নের রায়ের বাসালিয়ার কুলসুম জামান উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৮ জন, চরগাবসারা দাখিল মাদরাসার ৩০ জন, টেপিবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৫ জন, গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৫ জন ও রুহুলী উচ্চ বিদ্যালয়ে অন্তত ৪০ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। উপজেলার অন্যসব স্কুলেরও চিত্র একই রকম।  

জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা জানান, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। এর মধ্যে ভালো ছেলে পেয়ে অনেক অভিভাবকই তাদের মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছাত্রীদের বিয়ের বিষয়টি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়নি। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ভয়ে তারা শিক্ষকদেরও কিছু জানাননি। তবে বাল্যবিবাহের শিকার অনেক শিক্ষার্থীই বিদ্যালয়ে নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছে এবং পড়াশোনা করছে। বাল্যবিবাহ বন্ধে প্রশাসনের জোড়ালো পদক্ষেপ এবং এর কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে পারলে এ সমস্যা অনেকাংশেই কমে আসবে।

ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী জেসমিন জানায়, বাবা-না থাকায় এবং পারিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।   

একই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী লাবণী সরকার জানান, পরিবারের ইচ্ছার কারণেই আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে। তারপরও পড়াশোনা বন্ধ করিনি।  নিয়মিত বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি।

কয়েকজন অভিভাবক জানান, তারা দরিদ্র মানুষ। ভালো পাত্র পেয়েছেন তাই মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন।

হুগড়া হাবিব কাদের উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামীম আল মামুন বলেন, ‘করোনার কারণে গত বছর মার্চে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ দিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো না। গত ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল খোলার পর অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থী অনুপস্থিত রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে অনুপস্থিত ছাত্রীদের মধ্যে প্রায় ৬০ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে। স্কুলটি চরাঞ্চলে হওয়ায় এখানে বাল্যবিয়ের প্রবণতা আগে থেকেই রয়েছে। বিদ্যালয় খোলা থাকলে শিক্ষকরা মিলে ছাত্রীর বিয়ের উদ্যোগ বন্ধ করতেন।’

হুগড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন খান বলেন, ‘সবাই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যস্ত ছিলো। এই সুযোগে অনেক অসচেতন অভিভাবক তাদের নাবালক মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে এতো বেশি সংখ্যক বিয়ে হতো না। স্কুলের শিক্ষকদের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিরাও বাল্যবিয়ে বন্ধে ভূমিকা রাখতেন।’

মানব প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার কর্মী মাহমুদা শেলী বলেন, ‘শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী জেলায় এক হাজারের অধিক ছাত্রী বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছেন। বাল্য বিয়ের শিকার এসব ছাত্রীদের চিহ্নিত করে স্কুলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’

টাঙ্গাইল জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা লায়লা খানম বলেন, ‘করোনাকালে কিছু অসচেতন অভিভাবক তাদের মেয়েদের নির্ধারিত বয়সের আগেই বিয়ে দিয়েছেন। এসব মেয়েদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। আমরা জানতে পেরেছি স্কুল বন্ধ থাকার সময় ১ হাজার ২৪২ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে স্কুলগুলোর শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে সচেতনতা মূলক কার্য্ক্রম চালানো হবে।’

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. আতাউল গনি বলেন, ‘অসচেতন অভিভাবকরা স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। তবে ওইসব শিক্ষার্থী যাতে আবার ক্লাসে আসতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা হবে। বাল্য বিয়ের কুফলসহ প্রতিরোধে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জনসচেতনামূলক সভা আয়োজন করা হবে।’