সারা বাংলা

শুভর হাতে এখন স্ক্রু ড্রাইভার

স্কুলে তো যেতে চাই। এবার আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি, বইও আছে আমার। বন্ধুদের যখন স্কুল যেতে দেখি, তখন আমারও স্কুলে যেতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু বাবা যেতে নিষেধ করে। 

মটর সাইকেলের স্ক্রু টাইট দিতে দিতে এভাবেই তার পড়ালেখার প্রতি আগ্রহের কথা জানায় শুভ। মুখে নজরকাড়া মুচকি হাসি নিয়ে শুদ্ধ ভাষায় বেশ গুছিয়ে কথাগুলো বলে ১১ বছর বয়সী এই শিশুটি। 

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বাসস্ট্যান্ড বাজারের মটর সাইকেল মেকারের গ্যারেজে কাজ করে শুভ। গ্রাহক গাড়ি নিয়ে গেলে সেই গাড়িটি গ্যারেজে ঢোকানো, গাড়ি ধোয়া মোছা করা ও ওস্তাদের সঙ্গে ছোটো ছোটো কাজে হাত লাগানো শুভর দায়িত্ব। দিন শেষে পারিশ্রমিক ৬০ টাকা। যে বয়সে হাতে থাকবে বই, কাঁধে স্কুল ব্যাগ সেই বয়সে তার হাতে স্ক্রু ড্রাইভার। 

শুভ জানায়, জেলা সদরের জগন্নাথপুরে বাসা তার। পড়ালেখা করে বড় চাকরি করার ইচ্ছে ছিলো শুভর। ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে সে। করোনার সময় তার বেশ কিছু বন্ধুর মতো তাকেও কাজে লাগিয়ে দেন তার দিনমজুর বাবা। তবুও স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়ে ঘরে না জানিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় শুভ। তার বাবা তা জানার পর স্কুলে যেতে নিষেধ করেছে। 

কথা হয় শুভর বাবা কালিদাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, পড়া লেখা করে কি হবে। কোনো লাভ নাই। চাকরি পেতেও টাকা লাগবে।  কাম শিখলেই লাভ। 

কালিদাস জানান, শুভ যা আয় করে তা দিয়ে সংসারে কিছুটা সহযোগীতা হয়। স্কুলে গেলে কে দিবে তাকে সেই টাকা। পড়ালেখা ধনীদের জন্য গরীবের জন্যে নয়।

শুভর মতো পাশের দুটি মেকারের দোকানেও আদিত্য ও সজিব নামে দুজন শিশুকে কাজ করতে দেখা যায়। তারা  ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তাদের গল্পটাও অনেকটা শুভর মতই। করোনাকালে কাজে ঢোকার পর আর স্কুলে যায়নি তারা।

শিশুশ্রম নিয়ে কথা হয় একটি মোটরসাইকেল গ্যারেজের মালিক দিনেশের সঙ্গে। তিনি জানান, তার গ্যারেজে সবসময় শিশুরা কাজ করে। নিজেও শিশুকাল থেকে কাজ করে আসছেন। কখনো শুনেননি শিশুরা কাজ করতে পারবে না। তাছাড়া কাউকে তিনি কাজ করতে জোর করেনি। শিশু ও শিশুর পরিবারের কথাতেই তাদের কাজ দিয়েছে দিনেশ। 

শিশুদেরনিয়ে কাজ করা সমাজ সেবিকা হেলেনা পারভিন মনে করেন, দারিদ্র্যের কষাঘাত ওদের (শিশুদের) শ্রেণিকক্ষে যেতে বারণ করে। আর করোনা এ দরিদ্রতায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা। অনেকেরই স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে উপবৃত্তির টাকা, বিনামূল্যের বই ওদের জন্যও বরাদ্দ থাকে। এসব অনুদান নিয়েও পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে কাজে নামে শিশুরা। স্কুলে যাওয়ার বদলে যেতে হয় হাট-বাজারে। খেলতে মাঠে যাওয়ার বদলে যেতে হচ্ছে কাজে।

হেলেনা পারভিন বলেন, সরকারকে শিশু শ্রম বন্ধ করতে আরও তৎপর হতে হবে। তাদের শিক্ষা ও বিনোদন নিশ্চিত করতে বিশেষ নজর দিতে হবে। পাশাপাশি দেশের বিত্তশালীরা যদি এসকল পরিবারের সন্তানদের কিছু কিছু করে দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হয় তাহলে শিশু অধিকার রক্ষায় দেশ এগিয়ে যাবে।