সারা বাংলা

মুক্তিযুদ্ধে যে হাতে বন্দুক চালিয়েছেন সেই হাত আজ অবশ

ঝালকাঠির যে ক’জন নারী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মনুজা বেগম (৬৫)। এক সন্তানের জননী মনুজা বেগম এখন বিধবা। যে হাত দিয়ে পাকসেনাদের প্রতিহত করেছেন, বন্ধুক চালিয়েছেন, উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে তার একটি হাত অবশ হয়ে পড়েছে। অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছেন না এই নারী মুক্তিযোদ্ধা।

৭১-এ মনুজা বেগম সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। এখনও তার স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা। যখন শুনলেন পাকসেনারা হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে- তারা বাংলার মানুষ নয়, জমি চায়। এজন্য গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়েদের সম্মান নষ্ট করছে তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে যাবেন। একটা হলেও পাকসেনা মারবেন।

মনুজা বেগম জানতে পারেন মুক্তিযোদ্ধাদের দলে আরও অনেক মেয়ে কাজ করছে। এ কথা শুনে তিনি উৎসাহিত হন। বাড়ি থেকে প্রথমে তিনি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভীমরুলী এলাকায় চলে যান। সেখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন এলাকায় অপারেশন চালাচ্ছিলেন। ক্যাম্পে তার সঙ্গে পরিচয় হয় মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেনের সঙ্গে। ক্যাম্পের কমান্ডার আব্দুল হাই তাকে জানান আমির হোসেন তাকে ভালোবাসেন। তিনি রাজী থাকলে বিয়ে করতে চান। কিন্তু এ বিয়েতে ধর্ম ছিল প্রধান বাধা। মনুজা বেগম সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তিন দিন সময় চেয়ে নেন। এসময় তিনি একজন অভিভাবকের অভাব অনুভব করছিলেন। অবশেষে তিনি বিয়েতে রাজি হন।

যুদ্ধকালীন স্মরণীয় একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মনুজা বেগম বলেন, “একবার বেশ কিছু নারী-পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা খাওয়া শেষ করে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমন সময় এক নারী সেখানে আসে। ক্ষুধার্ত থাকায় আমরা তাকে ভেতরে নিয়ে খাবার দেই। কিন্তু সে ছিল গুপ্তচর। এর ৩-৪ ঘণ্টা পরেই পাকসেনারা আমাদের ক্যাম্পে হামলা করে। অপ্রস্তুত থাকায় আমরা প্রতিহত করতে গিয়ে সেদিনের মতো পিছু হটতে বাধ্য হই। তারা আমাদের দুজন পুরুষ ও তিন জন নারীকে ধরে নিয়ে যায়। আমি সেদিন পাশে একটি পুকুরে কচুরিপানার মধ্যে লুকিয়ে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাই।

‘এরপর দ্রুত অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে প্রতিশোধের পরিকল্পনা করে ফেলি। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা পাকসেনাদের ক্যাম্পে হামলা করি। এই যুদ্ধে আমি বন্দুক নিয়ে সরাসরি অংশ নিয়েছিলাম।”

এই যুদ্ধের কথা ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার আব্দুল হাই পনা ‘কাউখালি ও ধানসিঁড়ি বাঁকের মুক্তিযুদ্ধ’ বই-এর ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। এদিন যুদ্ধে আরও ৯ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিয়েছিলেন। পাকসেনারা পালিয়ে যাওয়ায় ‘একজন হলেও পাকসেনা মারার ইচ্ছা’ সেদিন মনুজা বেগমের পূরণ হয়নি।