সারা বাংলা

পেশা বদলাচ্ছেন বেদেরা

সড়কের পাশে বা নদীর ধারে ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে দল বেঁধে বসবাস করেন বেদেরা। সারাদিন গ্রামে গ্রামে সাপ খেলা, শিঙা লাগানো, তাবিজ কবজ বিক্রিসহ নিজস্ব পদ্ধতিতে নানা চিকিৎসা করে টাকা আয় করেন তারা। পরিবার-পরিজন নিয়ে এভাবেই যুগ যুগ ধরে পেশা আঁকড়ে ধরে থাকছেন বেদেরা।

এক সময় এমন চিত্র দেশের প্রায় সর্বত্র দেখা যেত। তবে বর্তমানে গুগল, ইউটিউব আর ফেসবুকের যুগে তাবিজ-কবজে মানুষ আর বিশ্বাস করেন না। রোগ হলেই ছুটে যান হাসপাতালে, শরণাপন্ন হন চিকিৎসকের। ফলে বাধ্য হয়ে বেদেরা তাদের পেশা বদলাচ্ছেন। তাদের মধ্যে যারা কিছু কাজ জানেন না, ব্যবসা করার টাকা নেই বা চাষ করার জমি নেই; শুধুমাত্র তারাই বাপ দাদার পেশা আঁকড়ে আছেন। এখন আয় তেমন না হলেও পরিবার নিয়ে কোনরকম বেঁচে থাকার তাগিদ তাদের।

তবে পুরোপুরি কাজ না শিখে মানুষকে তাবিজ কবজ, ঝাড়-ফুঁক দেয়- এমন এক ধরণের বেদে বের হয়েছে। এরা অপেশাদার নকল বেদে, এরা তাদেরই একটি শ্রেণি। তাদের জন্য এই ব্যবসায় আরও দ্রুত ধস নেমেছে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

মোহনগঞ্জ পৌরশহর ঘেঁষা সাপমরা খালের পাশে পলিথিনে ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর তুলে তাতে উঠেছেন নয়টি বেদে পরিবার। শুক্রবার বিকেলে তাদের সরদার মো. সাইফুল সরদারের (৫৮) সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, নয় পরিবারের সবারই আদি নিবাস ঢাকার সাভারে। সময় বদলের সাথে সাথে কাজের খুঁজে দীর্ঘ ২০ বছর আগে তারা শেরপুর জেলার জিনাইগাতী উপজেলার দক্ষিণ ডেপলাই গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। এখন ডেলাই গ্রামই তাদের ঠিকানা। বছরে ২-৩ মাস নিজ গ্রামে থাকা হয়। বাকি মাসগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে হয়।

সরদার সাইফুল বলেন, আমাদের প্রতিটি দলে একজন করে সরদার থাকে। সরদারের নির্দেশ সবাই একবাক্যে পালন করে। ৩১ বছর যাবত সরদারি করছি। এই সময়ে বহুবার মোহনগঞ্জে এসেছি। আগে নদীর ধারে নৌকায় থেকে গ্রামে গ্রামে গিয়ে শিঙা লাগানো, সাপ খেলা দেখানো, তাবিজ-কবজ বিক্রি করতাম। নদীতে এখন আর আগের মতো পানি থাকে না। ফলে বেশ কয়েক বছর যাবত পলিথিনের ছোট ঝুপড়ি ঘরে থেকেই কাজ করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ১০-১২ বছর আগেও শত শত বেদে দল বেঁধে বের হতো দেশের বিভিন্ন জেলায়। সময় বদলেছে, মানুষ এখন আর তাবিজ-কবজে বিশ্বাস করে না। অসুখ হলে সবাই হাসপাতালে চলে যান। এ পেশায় আর আগের মতো আয় নেই। বেদেরা বাধ্য হয়েই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। আমাদের মধ্যে যাদের একটু টাকা পয়সা আছে তারা দোকান খুলে এলাকায় ব্যবসা করছে। কেউবা জমি চাষ করছে। আমাদের টাকাও নেই জায়গা জমিও নেই; তাই পেটের দায়ে বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে কোনরকম বেঁচে আছি। 

তিনি আরও বলেন, পুরোপুরি কাজ না শিখে মানুষকে তাবিজ কবজ, ঝাড় ফুঁক দেয় এমন এক ধরণের বেদে বের হয়েছে। এরা অপেশাদার নকল বেদে, এরা আমাদেরই একটি শ্রেণি। তাদের জন্য এই ব্যবসায় আরও দ্রুত ধস নেমেছে।

সাইফুল বলেন, আমাদের মধ্যে নারীরাই বেশি কাজ করেন। শরীরে বিষ-ব্যথা হলে শিঙ্গা লাগিয়ে বদ রক্ত বের কার, বিভিন্ন সমস্যা বা রোগের তাবিজ-কবজ দেয়া, পানিতে স্বর্ণ পড়লে তোলে দেওয়া; মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এসব কাজ নারীরা করেন। আর পুরুষরা শুধু সাপ ধরা ও সাপ খেলা দেখায়। তবে স্থানীয়রা তাদের বিভিন্ন সহায়তা করে। এখানে নদীর পাড়ে খোলা জায়গায় নারীদের সাথে নিয়ে থাকতে গিয়ে কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। প্রথম দিনই থানায় গিয়ে যোগাযোগ করে ওসির পরামর্শে ডিউটি অফিসারের নাম্বার নিজের সঙ্গে রেখেছেন সরদার। আশপাশের লোকজনও খুবই মানবিক বলে জানিয়েছেন সাইফুল।

যে জায়গায় বেদেরা ঝুপড়ি ঘর তুলেছেন সেই জায়গার মালিক শামছু মিয়া। তিনি বলেন, বেদেরা আমাদের এলাকায় আসে বিভিন্ন কাজ করে আয় করার জন্য। এটা তাদের পেশা। আমি জায়গা দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে পানিসহ আমার বাসা থেকে যত রকমের সহায়তা দরকার দিচ্ছি। কোনো সমস্যা হলেও আমাকে অবগত করতে বলেছি। 

মোহনগঞ্জ থানার ওসি রাশেদুল হাসান বলেন, তাদের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা যেন না হয়; সেই বিষয়ে খোঁজখবর রাখছি।