বিজ্ঞানের বদৌলতে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহার বেড়েছে। হারিয়ে যেতে বসেছে এক সময়ে গ্রামীণ জীবনের অতি জরুরি কেরোসিন তেলের কুপি (লেম্পু), হারিকেন আর হ্যাজাক লাইট।
রাজবাড়ী শহরের এক সময় জমজমাট ছিল ঝালাই পট্টি। সেখানে প্রচুর পরিমাণে টিনের কুপি, হারিকেন তৈরি হত। কাজ করতেন অনেক কারিগর।
কুপি হচ্ছে টিনের তৈরি বিশেষভাবে আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা, যা কেরোসিন তেল দিয়ে কাপড়ে তৈরি সলতে (কাপড় মোচড়ানো) আগুন জালিয়ে আলো তৈরি করা হয়। এখনো কয়েকটি দোকানে যে কুপি পাওয়া যায় তা প্রতিটি ২৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
হারিকেন হচ্ছে কেরোসিন তেলের মাধ্যমে বদ্ধ কাচের পাত্রে আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা। এর বাহিরের অংশে অর্ধবৃত্তাকার কাচের অংশ থাকে। সাধারণত এই কাচের অংশকে চিমনি বলে থাকে, এর ভেতরে থাকে কাপড়ের সলতে। এই সলতে তেল শোষণ করে এবং তাতে অগ্নিসংযোগ করলেও ধরে আগুণ। আলো কমানো বা বাড়ানোর জন্য থাকে চাকতি। যেটি হারিকেনের বহিরাংশের নিচের দিকে থাকে। যেটি ঘুরিয়ে কমালে-বাড়ালে সলতে উঠা নামার সাথে আলোও কমে-বাড়ে।
অনেক কাল আগে থেকে হারিকেনের ব্যবহার শুরু হয়। ধারণা, মোঘল আমলের আগে থেকে বাংলায় শুরু হয় হারিকেনের ব্যবহার। এখনো গ্রামাঞ্চলে রিকশার নিচে আলোর উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই হারিকেন। প্রতিটি হারিকেন বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৫০০ টাকায়।
হারিকেনের মতোই আরো উন্নত প্রযুক্তিগত ব্যবহার হয় হ্যাজাকে। যেটি আরো বেশি আলো দিতে সক্ষম। হ্যাজাক বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সারা বিশ্বে প্রখর আলোক বাতি হিসাবে ব্যবহৃত। যা সংযুক্ত বাল্ব-আকৃতির জালের মতো আবরণ (ম্যান্টেল) উত্তপ্ত হয়ে উজ্জ্বল আলো বিকিরণ করে। কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়ে কোথাও হ্যাজাক পাওয়া যায়নি।
বৈদ্যুতিক বাতি এবং সোলার প্যানেলের ব্যবহারে কাজ কমে গেছে কুপি, হারিকেন তৈরির কারিগরদের। দিনরাত যেসব শ্রমিকরা ব্যস্ত থাকতো কুপি হারিকেন তৈরি করতে। তারা এখন হাত গুটিয়ে বসে থাকেন।
সাইদুল নামের এক কারিগর জানান, ‘দু-চারটে যা বিক্রি হয় তা দিয়ে সংসার চালানো কষ্ট হয়ে পড়েছে।’
কুপি কিনতে আসা রহিম মোল্লা জানান, ‘এখন আর কুপির দরকার পড়ে না। তবু একটা কিনতে এসেছি দোকানের জন্য। বিদ্যুৎ চলে গেলে জ্বালাই।’
কুদ্দুস নামের এক ব্যক্তি জানান, ‘ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি কুপির আলোয় পড়াশোনা করে। যারা একটু সম্ভ্রান্ত তারা হারিকেন ব্যবহার করতো আর মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তরা লেম্পু ব্যবহার করতাম। কোন অনুষ্ঠানে কিংবা মাতবরের বাড়িতে হ্যাজাক দেখা যেত। দিন বদলে গেছে। তবু মনে হয় সেই দিনগুলোই ছিল সোনালী সময়।’
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জ্যোতি দত্ত কাঁকন বলেন, ‘কুপি, হারিকেন বিলুপ্তিতে প্রথমত আমরা হারাতে বসেছি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। সেই স্বর্ণালী অতীত এখন আর নেই।’
তিনি আরো বলেন, সোলার প্যানেল, আইপিএস বা ব্যাটারিচালিত বাতির প্রচলনে আমাদের শরীর এবং মনের ওপরেও প্রভাব ফেলেছে। আগে আমরা দিন এবং রাতের পার্থক্য করতাম। অধিকাংশ কাজ দিনেই শেষ করতাম। দ্রুত ঘুমাতে যেতাম আবার দ্রুত উঠতাম। আর এখন আমরা অনেক কাজই রাতের জন্য রেখে দিই। কারণ, এখন দিন এবং রাতের পার্থক্য করি না। দিনে যে সুযোগ পাচ্ছি রাতেও সেরকম সুযোগ পাচ্ছি। ‘সানলাইট’ এ কাজ শেষ করতে হবে এরকম তাগিদ অনুভব করি না। যে কারণে নিদ্রাহীনতায় ভুগছি। যা শরীর ও মনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’