নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে গরুর মাংস কেনা যেন নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বিলাসিতা। কুমিল্লা নগরীর হকার, রিকশাচালক ও ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা প্রায় সবাই শেষ গরুর মাংস খেয়েছেন গত কোরবানির ঈদে। এদের মধ্যে অনেকেই আবার ‘গরুর মাংস বড় লোকের খাবার’ বলে মন্তব্য করেছেন।
সরেজমিনে কুমিল্লার কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, হাড্ডিসহ গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ টাকায়। হাড্ডি ছাড়া প্রতি কেজি মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়।
টমছম ব্রিজ কাঁচাবাজারের গরুর মাংস বিক্রেতা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নিত্যপণ্যের সাথে গরুর মাংসের দামও বেড়ে গেছে। নিম্ন আয়ের মানুষ খুব কমই আসেন মাংস নিতে। মাঝে মধ্যে ২৫০ গ্রাম মাংস কিনতেও আসেন কেউ কেউ।’
কুলফি বিক্রেতা মাসুদ মোল্লা জানান, জীবিকার তাগিদে কুষ্টিয়া থেকে কুমিল্লা এসেছেন। সংসারে দুই মেয়ে, এক ছেলে, স্ত্রী ও মা-বাবা আছেন। সবাইকে নিয়ে থাকেন নগরীর রেইসকোর্সে।
নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে কেমন আছেন মাসুদ? বলেন, ‘আগে কিছুটা ভালো চলতে পারতাম। এখন জীবন কোনো রকম যাচ্ছে। সব দিকের খরচ যোগান দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলছে সংসার।’
শেষ কবে গরুর মাংস খেয়েছেন জানতে চাইলে এই হকার বলেন, ‘ছেলেকে সুন্নতে খৎনা করিয়েছিলাম চার মাস আগে। ওই সময় দুই কেজি গরুর মাংস কিনেছিলাম। এখন তো দুই কেজি মাংস কিনলে ব্যবসার পুঁজি শেষ হয়ে যাবে।’
নগরীর টাউন হল গেইটে ডিম বিক্রি করেন মহিন। জীবন কেমন চলছে? প্রশ্ন শুনে চোখের পানি ছেড়ে দেন। অশ্রুমাখা কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের কষ্ট আল্লাহ ছাড়া কেউ দেখে না। ছোট্ট একটা মেয়ে হইছে গত রোজার ঈদের আগে। বাবা হয়ে একটা সুতাও কিনে দিতে পারিনি।’
গায়ে থাকা টি-শার্টে চোখের পানি মুছতে মুছতে মহিন বলেন, ‘পুরুষ মানুষ অল্প কষ্টে কাঁদে না! করোনার সময়টা কীভাবে কাটিয়েছি এক আল্লাহ সাক্ষী। আমরা তো কারো পরিচিত না, তাই কোনো অনুদানও পাই নায়। কোরবানি আসলে প্রতিবেশীরা গরুর মাংস দেয়। গত কোরবানি ঈদে যে গরু মাংস খাইছি আর খাই নায়!’
ক্ষুদে এই ব্যবসায়ী আরো জানান, এখন যা ইনকাম হয় তা দিয়ে কোনো রকম সংসার চলে। দিন শেষে আয়-ব্যয় সমান। এক ছেলে, এক মেয়ে, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে তার পরিবার।
রিকশাচালক বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘গাইবান্ধা থেকে কুমিল্লা এসেছি এক বছর হলো। আগে ঢাকায় রিকশা চালাতাম। তবে এখন সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর অনুমোদন নেই। তাই কুমিল্লা এসেছি। ৩৫০ টাকা দৈনিক ভাড়া হিসেবে এক মহাজন থেকে রিকশা নিয়েছি। প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা আয় করতে পারি।’
শেষ কবে গরুর মাংস খেয়েছেন? এমন প্রশ্নে বিল্লাল হোসেন লাজুক মুখে বলেন, ‘আমাদের কি আর বিলাসিতা মানায়? মাঝে মধ্যে বাসায় মেহমান আসলে মুরগি এনে খাই। কুরবানির ঈদে কেউ গরু মাংস দিলে খেতে পারি। কিনে খাওয়ার তৌফিক নাই।’
নগরীর মোগলটুলি এলাকার চা দোকানি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘গরুর মাংস কিনে খাওয়ার সাহস হয় না। এই বছরে গরুর মাংস খাই নাই। সাত থেকে আট মাস আগে কিনে খেয়েছিলাম। গরুর মাংস আমাদের জন্য না, এটা বড় লোকের খাবার।’