সারা বাংলা

যশোমাধবকে মাসীর বাড়ি নিতে প্রস্তুত রথ

জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি যাওয়া উপলক্ষে ঢাকার ধামরাইয়ে প্রতি বছরই শুক্লা পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথ টান অনুষ্ঠিত হয়। চাকার ওপর বসানো বিশেষ রথের ভেতর দেবতার মূর্তি বসিয়ে চালিয়ে যশোমাধবকে নেওয়া হয় মাসির বাড়ি।

এবছর রথযাত্রাকে সামনে রেখে এরইমধ্যে শেষ করা হয়েছে সাজসজ্জার কাজ। গত এক মাস ধরে কাঠামো মেরামত ও রঙের কাজ শেষে রথ সেজে উঠেছে নতুন রূপে। আজ শুক্রবার (১ জুলাই) রথটানার মধ্যে দিয়ে এই অর্চনার শুরু হবে।

ধামরাই রথের আদ্যপান্ত নিয়ে কথা হয় যশোমাধব মন্দির পরিচালনা পর্ষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নন্দ গোপাল সেনের সঙ্গে। রাইজিংবিডিকে তিনি জানিয়েছেন রথযাত্রার ইতিহাস।

যশোপাল থেকে যশোমাধব হলেন রাজা

ধামরাই এলাকার রাজা ছিলেন শ্রী যশোপাল। সেইসময় আশুলিয়ার শিমুলিয়া থেকে সৈন্য সামন্ত নিয়ে ধামরাইয়ের কাশবন ও দুর্গম এলাকা পার হয়ে পাশের এক গ্রামে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে কায়েত পাড়ায় এসে মাটির ঢিবির সামনে থেমে যায় তাকে বহনকারী হাতি।

রাজা শত চেষ্টা করেও হাতিটিকে সামনে নিতে পারলেন না এবং অবাক হলেন। তখন তিনি হাতি থেকে নেমে স্থানীয় লোকজনকে ওই মাটির ঢিবি খনন করার জন্য নির্দেশ দেন। সেখানে একটি মন্দির পাওয়া যায়। এছাড়া কতগুলো মূর্তি পাওয়া যায়। এর মধ্যে শ্রীবিষ্ণুর মূর্তির মতো শ্রীমাধব মূর্তিও ছিল। রাজা ভক্তি করে সেগুলো সঙ্গে নিয়ে আসেন। সেদিন রাতে মাধব দেবকে স্বপ্নে দেখেন রাজা যশোপাল। মাধব তাকে নির্দেশ দেন পূজা করার। আর বলে দেন নামের সঙ্গে মাধবের নাম বসিয়ে নেওয়ার। এরপরেই যশোপালের নাম হয়ে যায় যশোমাধব। পরে ধামরাই সদরে ঠাকুরবাড়ি পঞ্চাশ গ্রামের বিশিষ্ট পণ্ডিত শ্রীরামজীবন রায়কে তিনি ওই মাধব মূর্তি নির্মাণের দায়িত্ব দেন। এখনও সেই মূর্তির পুজোর প্রচলন রয়েছে। সময়টি ছিল চন্দ্র আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথি। সেই থেকেই শুরু হয় যশোমাধবের পূজা।

যেভাবে যারা বানান রথ

বাংলা ১২০৪ থেকে ১৩৪৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা জেলার সাটুরিয়া থানার বালিয়াটির জমিদাররা বংশানুক্রমে এখানে চারটি রথ তৈরি করেন। ১৩৪৪ সালে রথের ঠিকাদার ছিলেন নারায়ণগঞ্জের সূর্য নারায়ণ সাহা। এ রথ তৈরি করতে সময় লাগে এক বছর।

ধামরাই, কালিয়াকৈর, সাটুরিয়া, সিঙ্গাইর থানার বিভিন্ন কাঠশিল্পী যৌথভাবে নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করে ৬০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন রথটি তৈরি করেন। এ রথটি ত্রিতলবিশিষ্ট ছিল, যার ১ম ও ২য় তলায় চার কোণে চারটি প্রকোষ্ঠ ও তৃতীয় তলায় একটি প্রকোষ্ঠ ছিল।

বালিয়াটির জমিদাররা চলে যাবার পরে রথের দেখভালের দায়িত্ব পালন করতেন টাঙ্গাইলের রনদা প্রসাদ সাহার পরিবার।

মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত, ফের যাত্রা

১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল ধামরাই গণহত্যার দিনেই ঐতিহাসিক ধর্মীয় উৎসবের এই রথ পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানী বাহিনী। পুড়িয়ে দেওয়ার আগে, কাঠের তৈরি রথ ৪০ ফুট প্রস্থ, ৭৫ ফুট উচ্চতা, ৩ তলা বিশিষ্ট ও ৯টি প্রকোষ্ঠ, ৩২টি চাকা, এবং ৯টি মাথা বিশিষ্ট সৌন্দর্য শৈলীর নানা কারুকার্য খচিত ছিল। যেটির বয়স ছিল প্রায় চারশ বছর।

দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে এই রথ না থাকায় উৎসব বন্ধ ছিল এক বছর। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে ছোট আকারে একটি বাশঁ ও কাঠের রথ নির্মাণ করে উৎসব পালন করা হয়। ১৯৭৪ সালে বৃহৎ রথের আদলে ছোট পরিসরে কাঠের রথ নির্মাণ করে পুণরায় রথ উৎসবের নবযাত্রা শুরু হয়।

সবশেষ বাংলাদেশের সঙ্গে সেতু বন্ধন অটুট রাখতে ২০১৩ সালে ধামরাইয়ে পুরনো রথটির আদলে কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন রথ বানিয়ে দেন। ৪০ জন শিল্পী ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে নিরলসভাবে কাজ করে ৩৭ ফুট উচ্চতা ও ২০ ফুট প্রস্থের কারুকার্যখচিত নতুন রথটি নির্মাণ করেন। লোহার খাঁচার ওপর সেগুন ও চাম্বল কাঠ বসিয়ে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে আকর্ষণীয় সব শৈল্পিক নিদর্শন। এতে রয়েছে লোহার তৈরি ১৫টি চাকা। রথের সামনে রয়েছে কাঠের তৈরি দুটি ঘোড়া ও সারথি।এ ছাড়া রথের বিভিন্ন ধাপে প্রকোষ্ঠের মাঝে স্থাপন করা হয়েছে কাঠের তৈরি দেব-দেবীর মূর্তি। প্রতিবছর রথযাত্রার আগে রঙ ও সাজসজ্জার কাজ করে এটিতেই অনুষ্ঠিত হয় রথ উৎসব।'

যশোমাধব মন্দির পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক নন্দ গোপাল সেন বলেন, রথযাত্রা ও রথ মেলা উপলক্ষে রথের সাজসজ্জা ও পরিচর্যার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। রঙের কিছু কাজ চলছে। বাকি কাজও দ্রুত শেষ হবে। এরপর রথটান হবে। এছাড়া মাসব্যাপী মেলা হবে।

এবিষয়ে ধামরাই থানার পুলিশ পরিদর্শক (ওসি) আতিক রহমান বলেন, রথের নিরাপত্তায় সকল ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমাদের কর্মকর্তারা নজর রাখছেন। আশা করছি পুরো প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে শেষ হবে।