সারা বাংলা

নদী নয়, যেন সবুজের গালিচা

ময়ূর নদ। খুলনা নগরীর হৃৎপিণ্ড হিসেবে পরিচিত। নদটি এখন জীবিত থেকেও যেন মৃত। কারণ পুরো নদজুড়েই বিস্তৃত হয়েছে কচুড়িপানা। দেখলে মনে হবে এটি কোনো নদী নয়, যেন সবুজের গালিচা।

কচুড়িপানা এমন ভাবে নদটিকে আঁকড়ে ঢেকে রেখেছে- যেখানে পানির অস্তিত্ব একেবারেই অদৃশ্য। এছাড়াও ময়ূর নদে প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে বর্জ্য। ফলে দূষিত হিয়ে নিশ্বাস নিতে না পেরে বোবা কান্না করছে নদীটি। যা শোনার কেউ নেই।

সরেজমিনে দেখা যায়, দু‘ চোখ যতদূর যায়, ততদূরই কচুড়িপানা আর কচুড়িপানা। এমনভাবে কচুড়িপানার বিস্তার ঘটেছে যে, সামান্যমত ফাঁক-ফোঁকরও নেই। নদের পাড়ে দাঁড়িয়ে পানি পর্যন্ত দেখা যায় না। ফলে এটি যে নদ নাকি ভরাট হয়ে গেছে বোঝার কোনো উপায় নেই।

সোনাডাঙ্গা বাইপাস সড়কের সঙ্গে এ নদের ওপর নির্মিত দৃষ্টি নন্দন ময়ূর ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে শুধুমাত্র কচুড়িপানার সবুজ গালিচাই চোখে পড়বে। তবে এ ব্রিজের নিচে ইতোমধ্যেই খেজুরসহ বেশ কয়েকটি গাছ জন্মেছে। এমনকি গল্লামারি সেতু ঘিরেও নদটি মেরে ফেলার সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। বাজারের যত বর্জ্য সবই ফেলা হচ্ছে এ নদে। হচ্ছে দখলও। ফলে দুর্গন্ধ মিশছে বাতাসে।

জানা গেছে, খুলনা নগরের পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত ময়ূর নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার। আগে রূপসা নদীর সঙ্গে ময়ূরের সরাসরি সংযোগ ছিল। এখন সুইস গেটের মাধ্যমে জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রিত হয়। সুইসগেট বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে। ফলে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। 

সরেজমিনে দেখা যায়, গল্লামারী এলাকায় পাশাপাশি দুটি সেতুর নিচে রাশিরাশি বর্জ্য। দুর্গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। গল্লামারী বাজারের ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে স্থানটি। নদের পাড়ে জন্মানো আগাছা একেবারে মাঝনদীতে চলে গেছে। নর্দমার আবর্জনা  এসে পড়ছে নদে।

পরিবেশ সংশ্লিষ্টদের মতে, ময়ূরের মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর বড় একটি কারণ নগরের নালা-নর্দমা। নগরের গুরুত্বপূর্ণ ২০টির বেশি নালার মুখ ময়ূর নদের সঙ্গে যুক্ত। এসব নালা-নর্দমার ময়লা-আবর্জনা বিষাক্ত করে তুলছে নদের পানি। অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পরিবেশ বিষয়ে অসচেতনতা, অপর্যাপ্ত পানি প্রবাহসহ নানা কারণে ঐতিহ্যবাহী নদটি ব্যাপক দূষিত হচ্ছে।

ময়ূর নদের বুকে জন্ম নেওয়া খেজুর গাছ

খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান কনজারভেশন কর্মকর্তা আবদুল আজিজ বলেন, ‘শহরের সব বর্জ্য সংগ্রহের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট ও কর্মী নেই। নগরবাসীর উচিত ড্রেনে বা ফাঁকা জমিতে ময়লা না ফেলে কেসিসির সেকেন্ডারি ট্রান্সপোর্ট স্টেশনে ময়লা ফেলা।’

পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ময়ূর নদ থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের সংগ্রহ করা নমুনার জরিপ থেকে দেখা যায় নদের পানিতে বিশুদ্ধতার মানদণ্ড, আদর্শ সীমা থেকে বহু গুণে তারতম্য রয়েছে। বর্তমানে ময়ূর নদের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা রয়েছে প্রতি লিটারে দশমিক ২ থেকে দশমিক ৬ মিলিগ্রাম। যদিও ডিও’র আদর্শ মাত্রা প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলিগ্রামের বেশি হওয়া উচিত।’

খুলনার পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চের আহবায়ক অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা বলনে, ‘ময়ূর এখন বদ্ধ নদ। এই নদটি দখল- দূষণের দাপট ও প্রবাহ না থাকায় শুকিয়ে মরতে বসেছে। এর কারণ হচ্ছে  নদের উপর অপরিকল্পিত বাঁধ, ব্রিজ ও কালভার্ট তৈরি করা, সংযোগ খালগুলো দখল করে এই নদ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং খালগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন করে প্রকল্পে ব্যবহার করা উজানের সঙ্গে সংযোগ বিহীন/প্রবাহ বিচ্ছিন্ন হওয়া প্রভৃতি।’

তিনি আরও বলনে, ‘একাধিকবার এ নদের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু আবারও সব কিছু দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, নদে প্রবাহ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। প্রবাহ না থাকলে নদ-নদী টিকে থাকে না। শোনা যাচ্ছে, এই নদটি খনন করা হবে কিন্তু কবে, কোথায়, কি ভাবে বা কোন কর্তৃপক্ষ এই খনন কাজ বাস্তবায়ন ও তদারকি করবে তা অস্পষ্ট।’

ময়ূর নদ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা ও বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ জামান বলেন, ‘নদটি এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। আগের বার খনন কোনো কাজে আসেনি। নদটি নামকাওয়াস্তে খনন করা হয়েছিল। ভালো করে খনন দরকার। তবেই সুফল মিলবে।’

কেসিসির প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবির উল জব্বার বলেন, ‘নদটি খনন করা হচ্ছে। এ ছাড়া দুই পাড় বাঁধাই করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা, মাঝেমধ্যে দুই পাড়ের সংযোগ সেতু করা, বিনোদনের জন্য নৌকা চালানোর ব্যবস্থা রাখা, পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ হয়ে যাবে।’

খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, ‘ময়ূর নদের খনন কাজ দ্রুত শুরু হচ্ছে। এছাড়া জোয়ারের সময় দ্রুত পানি নিস্কাশনের সুবিধার্থে শহরতলীর আলুতলা দশভেন্ট গেটে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’