সারা বাংলা

শিক্ষার চেয়ে ভিক্ষায় আগ্রহী পথশিশুরা

শিক্ষার চেয়ে ভিক্ষায় বেশি আগ্রহী বরিশালের পথশিশুরা। স্কুল ফাঁকি দিয়ে রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন ভিক্ষা করছে এসব শিশু। ওদের ভিক্ষা চাওয়ার আবদারের বিব্রত হয়ে শেষ পর্যন্ত দুই একজন নগরবাসী ৫ থেকে ১০ টাকা ধরিয়ে দিচ্ছেন তাদের।

এদিকে শহরে পথশিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এসব শিশুদের স্কুলে ফেরাতে বা সমস্যার সমাধানে কোনো কার্যকারী ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছেনা কর্তৃপক্ষকে। ফলে দিন দিন নগরীতে বেড়েই চলেছে শিশু ভিক্ষুকদের সংখ্যা।

বরিশাল নগরীর বিভিন্ন অলিগলি সরেজমিনে দেখা গেছে, করোনা পরবর্তী রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করছে অনেক শিশু। অনেক শিশু স্কুল ফাঁকি দিয়ে সড়কে ভিক্ষা করে। এ থেকে যা আয় হচ্ছে তা দিয়ে কোনো কোনো শিশু সংসারে অর্থের জোগান দিচ্ছে। আর কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের নেশায় (ডেন্ডি, গাজা, সিগারেটর) আশক্ত হচ্ছে। 

বরিশালে বেশ কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার তথ্য মতে, বরিশালে ৩০ শতাংশ শিশু ভিক্ষুকের বয়স ৪-৬ বছর। ৪৫ শতাংশের বয়স ৭-১০ বছর ও ১১-১৩ বছর বয়সী ২৫ শতাংশ। এই সব শিশুদের মধ্যে মেয়ে ৩৫ শতাংশ ও ছেলে ৫০ শতাংশ। ভিক্ষায় জড়িত এসব শিশুর ৬৭ দশমিক ২০ শতাংশ লেখাপড়া জানে না। বাকিদের মধ্যে ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ দ্বিতীয় শ্রেণি ও ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করছে। মাদরাসার পড়া শিশুর সংখ্যা ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ। 

ভিক্ষাবৃত্তিতে আসার আগে কোনো কিছুই করত না এমন শিশু ভিক্ষুকের সংখ্যা ৩৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। প্রথম থেকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। ভিক্ষাবৃত্তির আগে ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ গৃহকার্যে, ৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ লেখাপড়া, পথশিশুর কাজে ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ শিশু হোটেল ও ভাঙারির কাজে নিয়োজিত ছিল। 

বরিশাল জেলায় ৬ হাজার ভিক্ষুকের একটি তালিকা রয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কাছে। ওই সংস্থাগুলোর করা জরিপ অনুযায়ী প্রতিবছর নদীভাঙন, ফসলহানি, দরিদ্র অবস্থায় উপনীত হওয়াসহ নানা কারণে গ্রামের ছিন্নমূল জনগোষ্ঠী কাজের সন্ধানে বা উন্নত জীবনের আশায় শহরমুখী হচ্ছে। আশানুরূপ কাজের সুযোগ না পেয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত হচ্ছেন তারা। এর এ কাজে এসব মানুষ নিজেদের শিশু সন্তানদেরকেও যুক্ত করছে। 

উন্নয়ন সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার করার জন্য একদিকে যেমন শিশুদের বিকলাঙ্গ করে তার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে, তেমনি সুস্থ শিশুকে ভিক্ষার কাজে ব্যবহার করার কারণে তাকে ধীরে ধীরে পরনির্ভরশীল জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এখান থেকে অনেক শিশু দ্রæতই অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠেন। এসব শিশুই পরবর্তী সময়ে মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে। তাদের দিয়ে মাদক বহনের ঘটনাও ঘটছে। 

বরিশাল বিএম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোরশেদা নাজনিন বলেন, ‘শিশুরা অনেক কিছুই জানে না বা বোঝে না। মা-বাবা বা অন্যরা শিশুদের ব্যবহার করে সহানুভূতি আদায় করে ভিক্ষা করছে। শিশুরা ছোট থেকে এ ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকার ফলে তারা পরনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। পরে তারা এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। শিশুকাল থেকে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত থাকার কারণে তাদের মানসিক গঠন ঠিকমতো হয় না। শিশু ভিক্ষুকদের শিক্ষার আলোয় এনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।’ 

শহীদ আবদুর রব সেনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের কাজী নাসির উদ্দিন বাবুল বলেন, ‘শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আমরা কেউ চাই না এরা ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন অতিবাহিত করুক। ভিক্ষাবৃত্তি শিশুদের পেশা হতে পারে না। শিশুদের জন্য এটা একটা অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে শিশুদের বের করে আনতে হবে।’

বরিশালের বিশিষ্ট সংগঠক জীবন কৃষ্ণ দে বলেন, ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত। এ সব শিশুদের সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। শিশুভিক্ষা ভিত্তি এটা আমাদের সমাজের জন্য কাম্য নয়। এ সব শিশুদের ভালোবাসা দিয়ে সঠিক পথে আনতে হবে। যারা শিশুদের স্কুলে না পাঠিয়ে ভিক্ষা করাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। শিশু আইনে উল্লেখ আছে কোন শিশু ভিক্ষা করতে পারবে না।’ 

বরিশাল জেলা প্রশাক মো. জসিম উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘যারা স্কুল ও মাদ্রাসা ফাঁকি দিয়ে ভিক্ষা করছে তাদের ঘরে ফিরানোর দায়িত্ব স্কুল কর্তৃপক্ষের। এসব শিশুদের সুরক্ষার জন্য ফান্ড আছে। জেলা প্রাথমিকে একজন করে দায়িত্বে রয়েছেন। সেক্ষেত্রে তারা যদি সিরিয়াস ভাবে দায়িত্ব পালন না করে তাহলে তো এ অবস্থা হবেই। এসব শিশুদের সুরক্ষার জন্য প্রথমে কাউন্সিলিং করতে হবে। যেসব শিশু নেশা গ্রস্থ হয়ে পরছে এদের এখন সঠিক পথে পরিচালিত করতে না পারলে ভবিষ্যত প্রজন্ম ধ্বংস হবে। তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শিশু ভিক্ষা বন্ধ করতে হবে।’ 

ভিক্ষুক নিরসনের জন্য বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার ভিক্ষুকদের বিভিন্ন কর্মস্থান সৃস্টি করে বরিশালকে ভিক্ষা মুক্ত নগরী ঘোষনা করেছিলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসকের ওই পদক্ষেপ কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে না বলে সূশীল সমাজের মন্তব্য।