সারা বাংলা

যেখানে শিক্ষার্থীদের চলাচলের একমাত্র ভরসা ‘নৌকা’

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া আশা করছেন সিরাজগঞ্জের চরের শিশুরা। একেকটি নৌকায় ১২ থেকে ১৫ জন শিক্ষার্থী ওঠেন। তাদের বিদ্যালয়ের আশা-যাওয়ার একমাত্র ভরসা নৌকা। এমনকি বাড়ি থেকে বের হতে একটু দেরি হলে সেদিন আর যাওয়া হয় না স্কুলে।

সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার সদিয়া চাঁদপুর ইউনিয়নের দুর্গম যমুনার শাখা নদীর পাশেই বোয়ালকান্দি দাখিল মাদরাসা এবং চরবোয়ালকান্দি ও রেহাইমৌশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যমুনার ভাঙনে বিপর্যস্ত। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪৫০ জন শিক্ষার্থীকে যমুনার ক্যানেল পার হয়ে যেতে হয় স্কুল ও মাদরাসায়। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ রয়েছে টাঙ্গাইল জেলার ইছাপাশা এলাকার। তারা সবাই বোয়ালকান্দি গ্রামের বাসিন্দা ছিলো। ২০১৯ সালের দিকে ঘর-বাড়ি নদীতে বিলীন হওয়ায় তারা ওই এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। তাদেরও একই অবস্থায় বিদ্যালয়ে আসতে হচ্ছে।

বিদ্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বোয়ালকান্দি একটি বিশাল বড় গ্রাম ছিলো। প্রতিবছর ভাঙতে ভাঙতে সিংহভাগ অংশ চলে গেছে যমুনার পেটে। যার কারণে নদীতে বিভিন্ন ক্যানেল সৃষ্টি হয়েছে। ক্যানেলে পানি থাকায় শিক্ষার্থীদের নৌকায় করে স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। আর এজন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন দিতে হতো ১০ টাকা। এতে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল অনেক কম। পরে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি নৌকা মালিকের সঙ্গে কথা বলে প্রত্যেক মৌসুমে একেকটি নৌকার মাঝিকে মাসে ৩ হাজার টাকা করে দেন। আর শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন পাঁচ টাকা দেয়। এতে উপস্থিতি এখন বেশ ভালো।

চরবোয়ালকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যলয়ের শিক্ষার্থী আসলাম, রোজিনা, মাইসা, মুন্নি ও আসিফ-এরা জানায়, প্রতিদিন সকালে বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় একমাত্র ভরসা নৌকা। এরপর স্কুলের পোশাক পরে বই-খাতা নিয়ে নৌকায় করে বিদ্যালয়ে যাওয়া। কোন সময় মাঝি না পেয়ে নিজেদেরই নৌকা চালাতে হয়। এ জন্য অনেক সময় ক্লাস ধরতে পারি না। 

নৌকার মাঝি শাহজাহান আলী বলেন, ঘাট থেকে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে নেওয়া-আনা করি। মাঝে মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী বাড়ি থেকে বের হতে দেরি করলে নৌকা ধরতে পারে না। আর তাতেই অনেক শিক্ষার্থীর ক্লাস মিস হয়ে যায়।

স্থানীয় কয়েকজন অভিভাবক জানান, উপজেলার সীমান্তবর্তী সদিয়া চাঁদপুর ইউনিয়নের যমুনার পূর্বপাড়সহ উপজেলার প্রায় ২৫টি বিদ্যালয়ের শিশুদের যাতায়াতের এমন করুণ অবস্থা কয়েক যুগ ধরেই। ঝড়বৃষ্টি উপক্ষো করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাথায় নিয়েই কোমলমতি শিশুরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে। তবে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে ৩ থেকে ৪টা বড় নৌকার ব্যবস্থা করলে বর্ষার শুরু থেকে পানি শুকানো পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাওয়াআশার অনেক সুবিধা হবে।

চরবোয়ালকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আহাম্মদ উল্লাহ জানান, যমুনা নদী ভাঙনের কারণে চরাঞ্চলে রাস্তাঘাট নেই বললেই চলে। বর্ষামৌসুমে চরাঞ্চল ডুবে থাকে। যমুনা নদীতে বর্ষার পানি কমলেও খাল-বিল ও শাখা নদীতে পানি না কমায় বছরের বেশির ভাগ সময় নৌকা ছাড়া যাতায়াতের আর কোনো উপায় থাকে না। ছোট্ট নৌকায় চরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে খুদে শিক্ষার্থীরা। এ কারণে অনেক শিশু এ সময় স্কুলে আসতে চায় না বা তাদের অভিভাবকরাও তাদের পাঠাতে চান না।

সদিয়া চাঁদপুর ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলাম সিরাজ জানান, চরাঞ্চলের নৌকায় প্রতিদিন শত শত মানুষ চলাচল করে। এতে বর্ষার পানি কমে গেলেও চরাঞ্চলের ক্যানেলে পানি থাকে। বছরের প্রায় ৫ মাস শিশু শিক্ষার্থীসহ সবাই নৌকায় চলাচল করে থাকেন। বিদ্যালয়ে যেতে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে সরকারিভাবে বড় নৌকা সরবরাহের দাবিও জানান তিনি।

চৌহালী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর ফিরোজ বলেন, উপজেলার সিংহভাগ প্রতিষ্ঠান যমুনার চরে অবস্থিত। যার ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নৌকায় পারাপার হতে হয়। আমরা এরই মধ্যে উপজেলার ১৬টি প্রতিষ্ঠানে নৌকা দিয়েছি। যে প্রতিষ্ঠানে নৌকা নেই সেই সকল প্রতিষ্ঠানেও নৌকার ব্যবস্থা করা হবে।