সারা বাংলা

রহিমার পরিবার ‘মামলাবাজ’ হিসেবে পরিচিত

খুলনার আলোচিত রহিমা বেগমকে পুলিশ ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে সুস্থ শরীরে উদ্ধার করার পর স্বস্তি ফিরে এসেছে রহিমা বেগমের মেয়ের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হওয়া ৬ জনের পরিবারে। তারা দাবি করেছেন, রহিমা বেগমের আত্মগোপন করা ছিল পুরোটাই ‘নাটক’। তাদের হেনস্থার জন্যই রহিমা বেগম স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেছিলেন। রহিমা বেগমের এই অন্তর্ধানের পেছনে তার সন্তানদেরও ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।

বিশেষ করে তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান, মাহমুদা আক্তার ও ছেলে মিরাজ ওরফে মো. সাদী। প্রতিবেশীদের দাবি রহিমা বেগম এবং তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান, মাহমুদা আক্তার ও ছেলে সাদী ভীষণ উচ্ছৃঙ্খল। এলাকায় তারা মামলাবাজ হিসেবে পরিচিত বলে জানান স্থানীয়রা।

রহিমা বেগমের মেয়ের দায়ের করা অপহরণ মামলায় গ্রেফতাররা হলেন— খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) প্রধান প্রকৌশল কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী মো. গোলাম কিবরিয়া, তার বড় ভাই মহিউদ্দিন, রহিমার দ্বিতীয় স্বামী হেলাল হাওলাদার, দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশার পলাশ, নূর আলম জুয়েল এবং হেলাল শরীফ।

রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) খুলনা নগরীর কুয়েট রোডের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়ার খামারবাড়ী এলাকার ৩৫ নম্বর রহিমা বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বন-জঙ্গলের মধ্যে ভাঙাচোরা দ্বিতলা বাড়ি। দিনেরবেলা সেখানে ভূতুড়ে অবস্থা। গেট পেরিয়ে ইট বিছানো পথে বাড়ির ভেতর গেলে দেখা যায়, বাড়ির নিচ তলায় দুটি পরিবার ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন।

রহিমা বেগমের বাড়ির ভাড়াটিয়া মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, প্রতিবেশী কারও সঙ্গে রহিমা বেগমের পরিবারের সদস্যদের সম্পর্ক নেই। রহিমা বেগমের মেয়ে মরিয়ম মান্নান ভীষণ উগ্র প্রকৃতির। তার অত্যাচারে এলাকার মানুষ টিকতে পারছে না। কথায় কথায় তিনি লোকজনকে মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।

ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া আকলিমা বেগম জানান, রহিমা বেগম এ বাড়িতে থাকেন না। তিনি তার দুই মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে নগরীর বয়রা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন। তবে মাসে এক-দুদিন তার বর্তমান স্বামী বেল্লাল ঘটককে নিয়ে এসে থেকে যান। ২৭ আগস্ট যে দিন রহিমা বেগম নিখোঁজ হন, তার আগের দিনও তিনি বেল্লাল ঘটককে নিয়ে এ বাড়িতে আসেন।

ভাড়াটিয়া আকলিমা বেগম বলেন, ‘‘২৭ আগস্ট রাত ১১টার দিকে দ্বিতলা থেকে নেমে এসে বেল্লাল ঘটক আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিল— ‘তোমরা রহিমাকে দেখেছ কি-না?’ এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি। বেল্লাল ঘটকই প্রথম সবাইকে জানিয়েছে, রহিমা বেগম নিখোঁজ হয়েছে।’’

তিনি বলেন, ‘রহিমা বেগম নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে আমরা আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। পুলিশ এসে শুধু আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমার ভাইকে, মনির হাওলাদারকে পুলিশ ধরে নিয়ে দুই দিন জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এক মাস ধরে আমরা খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম। এত দিন আমরা ঘুমাতে পারিনি। তাকে উদ্ধারের পর আমরা স্বস্তি পেয়েছি।’

রহিমা বেগমের নিখোঁজ হওয়ার পর তার মেয়ে আদূরীর দৌলতপুর থানায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে খুলনা কারাগারে রয়েছেন প্রতিবেশী মো. মহিউদ্দিন, তার ভাই গোলাম কিবরিয়া এবং আরেক প্রতিবেশী নূর আলম জুয়েল।

গোলাম কিবরিয়ার স্ত্রী আয়েশা বলেন, ‘রহিমা বেগমের সতীনের কাছ থেকে তাদের বাড়ির ২ কাঠা জমি প্রথমে একজন মহুরি কেনেন। সেই মহুরির কাছ থেকে আমার স্বামী গোলাম কিবরিয়া ওই জমি কিনে নেন। এরপর থেকে রহিমা বেগম ও তার ছেলে-মেয়েরা আমাদের মিথ্যা মামলাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করে আসছে। তাদের হয়রানির শিকার প্রতিবেশী সকলেই। তাদের সকলকে এলাকার লোকজন মামলাবাজ হিসেবে চেনে। ভয়ে তাদের সঙ্গে এলাকার কেউ কথা বলে না।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার স্বামী ও ভাসুরকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে। আমাদের সমাজের কাছে ছোট করা হয়েছে। আমরা রহিমা বেগম এবং তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান, ছেলে মিরাজসহ এই ঘটনার পেছনে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আর যারা মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হয়েছে অবিলম্বে তাদের মুক্তি চাই।’

রহিমা বেগমের মেয়ে আদুরীর মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে বন্দি নূর আলম জুয়েল। তার স্ত্রী সুমি বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘রহিমা বেগমের পরিবারের সদস্য খুব উচ্ছৃঙ্খল। এর আগেও রহিমা বেগম নিজের হাত নিজে কেটে আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। এবার নিজে আত্মগোপন করে তার মেয়েকে দিয়ে আমার স্বামীর নামে মিথ্যা মামলা করেছে। এখন আমার স্বামী কারাগারে বন্দি। আমার এক ও দুই বছরের সন্তান তার বাবার জন্য কান্নাকাটি করছে। আমরা রহিমা বেগম ও তার মেয়ে মরিয়ম মান্নানের কঠোর শাস্তি চাই। কেন, তারা আমাদের নামে মিথ্যা অপবাদ দিলো?’

মো. আওরঙ্গজেব খান দুলু, মৌসুমী আক্তার রহিমাসহ উদ্ধার হওয়া রহিমা বেগমের প্রতিবেশীরা জানান, রহিমা বেগম ও তার ছেলে-মেয়েরা এলাকায় মামলাবাজ বলে পরিচিত। তারা সবাই উচ্ছৃখল, কেউ তাদের ভালো বলে না। তারা এলাকাকে জর্জরিত করে দিয়েছে।

এলাকাবাসীরা জানান, রহিমা বেগমের প্রথম স্বামীর নাম মান্নান হাওলাদার। বাড়ির কাছে ফুলবাড়ি গেটে তিনি জুতা সেলাই ও কবিরাজী করতেন। এলাকার লোকজনের কাছে তিনি ‘মুচি হাজি’ নামে পরিচিত ছিলেন। এই স্বামীর পক্ষে পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। প্রথম স্বামী মারা যাওয়ার পর বেল্লাল ঘটক রহিমা বেগমের এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন। এরপর রহিমা বেগমের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। তিন-চার বছর আগে এই বেল্লাল ঘটককেই রহিমা বেগম আবার বিয়ে করেন।

পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্র জানায়, রহিমা বেগমের মেয়ে মরিয়ম মান্নান এক সময় ঢাকায় ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলনের নেত্রী ছিলেন। ওই সময় তিনি সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ ছাড়া তার ভাই মিরাজ ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের অঙ্গসংগঠন যুব আন্দোলনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কয়েক বছর আগে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন।

পিবিআই, খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মোশফিকুর রহমান বলেন, রহিমা বেগমের কাছে থাকা ব্যাগে খাবার ও কাপড়সহ বেশ কিছু ব্যবহারের মালামাল পাওয়া গেছে। এ ছাড়া উদ্ধারকালীন তিনি ফরিদপুরের ওই বাড়ির লোকদের সঙ্গে গল্প করছিলেন। এ সব আলামতে তাকে অপহরণের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয় না। এ কারণে রহিমা বেগম অপহরণের অভিযোগে গ্রেফতার ছয় জনের বিষয়ে আদালতেই সিদ্ধান্ত হবে।