সারা বাংলা

ট্রাফিক পুলিশ নেই, লুৎফরই ভরসা

জয়পুরহাট সদর উপজেলার ধারকী চৌরাস্তায় যানজট লেগে থাকলেও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এখানে হাজারো মানুষের ভোগান্তি ছিল নিত্যদিনের নিয়তি।

সেখানে নিজের উদ্যোগে গত তিন বছর ধরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে সড়কে স্বস্তি এনে দিয়েছেন লুৎফর রহমান (৬৫)। তবে এ কাজের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পারিশ্রমিক পান না তিনি। কেউ যদি খুশি হয়ে দু-চার টাকা দেন, তা দিয়েই কোনো রকমে চলে সংসার।

জানা যায়, ধারকী মোড়টি চারটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মধ্যে। এর পূর্ব দিকে জয়পুরহাট থেকে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক, পশ্চিম দিকে জয়পুরহাট থেকে বিসিক মোড়, উত্তর দিকে জয়পুরহাট থেকে হিচমি সড়ক এবং দক্ষিণ দিকে জয়পুরহাট হয়ে সুক্তারপুর মোড় হয়ে আক্কেলপুর পর্যন্ত।

শহরাঞ্চলে যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পুলিশ তৎপর হলেও গ্রামাঞ্চলের ভেতরে বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের সংযোগস্থল বা মোড়গুলোতে পুলিশের ট্রাফিক ব্যবস্থা সচরাচর দেখা যায় না। বিষয়টি বিবেচনায় এনে ধারকী চৌরাস্তা মোড়ে ব্যক্তিগতভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করেন লুৎফর।

সংসারে অভাব-অনটন থাকলেও ব্যক্তি জীবনে উদ্দীপনার কমতি নেই লুৎফরের। এক সময় রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে সংসার চালিয়েছেন, এখন বয়সের ভারে সে পেশা ছাড়তে হয়েছে।

জেলা সদরের কেশবপুর গ্রামের ট্রাক চালক শাহাদত হোসেন বলেন, ‘জয়পুরহাট ছাড়াও পাশের নওগাঁর বদলগাছি ও ধামইরহাট থেকে বগুড়া, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের পূর্বাঞ্চলগামী বাস ও ট্রাকসহ শত শত পণ্যবাহী যানবাহন ধারকী চৌরাস্তা মোড় হয়ে চলাচল করে। এ ছাড়া সড়কটির উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তের শতাধিক গ্রামের হাজার হাজার মানুষ ও ছোট বড় অনেক যানবাহনও চলাচল করে একই মোড় হয়ে। এখানে কোনো ট্রাফিক ব্যবস্থা না থাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটতো। লুৎফর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু করার পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে, পাশাপাশি কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।’

ধারকী মোল্লাপাড়া গ্রামের মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘লুৎফর রহমানের ব্যক্তিগত ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে এখানে বিভিন্ন যানবাহনের দুর্ঘটনায় কয়েকটি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় তিন বছর আগে লুৎফর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ট্রাফিক ব্যবস্থা শুরু করলে এলাকাটি দুর্ঘটনামুক্ত হয়।’

লুৎফর বলেন, ‘একেই তো বয়সের ভার, তার উপর শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে যাওয়ায় আর রিকশা চালাতে পারি না। ট্রাফিকের কাজে পুলিশ স্যারেরা অনেক উৎসাহ দেন, সাহায্যও করেন। বিভিন্ন গাড়ির ড্রাইভারসহ এলাকার বিত্তবানেরা দু-চার টাকা যা দেন, তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে। তবে ছোট মেয়েটার বিয়ে কিভাবে দিবো, তা নিয়েই চিন্তা হয়।’

সদর উপজেলার বম্বু ইউপির চেয়ারম্যান মোল্লা শামসুল আলমের ছেলে জাহিদ কায়সার রতন জানান, লুৎফর কখনো অসুস্থ হলেও তার দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করেননি। যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও দুর্ঘটনা রোধে অসামান্য অবদান রাখায় এলাকাবাসীসহ গাড়ি চালকরা তাকে সম্মান করে ‘বস’ বলেও ডাকেন।

লুৎফরের তিন মেয়ের মধ্যে দুইজনের বিয়ে দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন স্ত্রী ও আরেক মেয়েকে নিয়ে অভাবের সংসারর তার। অর্থাভাবে আরেক মেয়ের বিয়ে আটকে আছে। তারপরও লুৎফর কারও কাছে টাকা চায় না। কেউ ইচ্ছা করে দুই, চার, পাঁচ টাকা দিলে তা গ্রহণ করেন।’

জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার নূরে আলম বলেন, ‘ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে তিনি যে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তা দেখে মুগ্ধ জেলা পুলিশ প্রশাসন। সততা, নিষ্ঠা আর পরিশ্রম মানুষকে যে সম্মানিত করে প্রাইভেট ট্রাফিক লুৎফর রহমানই তার বড় উদাহরণ।’