সারা বাংলা

 দুর্যোগের ধাক্কায় ঝুঁকিতে খুলনা উপকূলে ফসল উৎপাদন

উপকূলীয় চারটিসহ খুলনার ৯ উপজেলায় চলতি বছর অনাবৃষ্টিতে আমন চাষে চরম বিঘ্ন ঘটেছে। পানির অভাবে প্রথমবার বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। তারপরেও বাড়তি খরচ করে মৌসুমের দেড় মাস পরে এক বুক আশা নিয়ে আমন চাষ শুরু করেন কৃষকরা। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংসহ দু’বার অতিবৃষ্টিতে ডুবে যায় আমন ক্ষেত। কিন্তু এরপরও মোটামুটি ফলন পাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন অধিকাংশ চাষি। তবে বর্তমানের কৃষকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারেন্ট ও মাঝড়া পোকা। 

এদিকে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা ও দাকোপ উপজেলার অধিকাংশ এলাকা। আম্ফান, ইয়াস ও করোনার ধাক্কা কাটিয়ে এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি উপকূলীয় এ চার উপজেলার হাজার হাজার কৃষক। 

অনাবৃষ্টির মধ্যেও কয়রা উপজেলার দক্ষিণ দেয়াড়া মৌজার (লক্ষীখোলা ও দেয়াড়া বিল) সহস্রাধিক বিঘা জমির পানি সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতায় রোপিত আমন ধান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বিগত দুই/তিন বছর জলাবদ্ধতায় ফলন ভালো না হওয়ায় লোকসান এড়াতে অনেকেই ফেলে রেখেছেন চাষের জমি। ফলে জমি থাকতেও জীবিকা নিয়ে চিন্তিত ওই বিলের ফসলের ওপর নির্ভরশীল চার শতাধিক পরিবার।

সরেজমিন লক্ষীখোলা ও দেয়াড়া বিলে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় এক তৃতীয়াংশ জমিতে কোনো ধান গাছ নেই। যতটুকু রয়েছে সেটারও চরম খারাপ অবস্থায়।

কথা হয় ওই এলাকার রুহুল কুদ্দুস, আব্দুল হাই, সালাম, জাহিদ, কওসার গাজীসহ কয়েকজন চাষির সঙ্গে। তারা জানান, সামান্য বৃষ্টিতে ও নোনা পানি উঠে জলাবদ্ধতায় তাদের বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। পানি কমে গেলে দূর থেকে চারা কিনে রোপণ করেন তারা। চারা রোপণের কিছুদিন পর প্রচুর বৃষ্টি হয়। ফলে পানিতে আবারো তলিয়ে যায় রোপিত চারা গাছ। চারা নষ্ট হওয়ার পর অনেকে আবারো আমন ধান রোপণ করেন। এতে বিঘা প্রতি ৮/৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত খরচের কারণে এখন কোনো কোনো চাষির ধান কাটার খরচও উঠবে না। কেউ কেউ বিঘা প্রতি ৬/৭ মণ ধান পেতে পারে। তবে অধিকাংশ চাষি বিঘা প্রতি ৩/৪ মণ ধান পাবেন বলে তাদের ধারণা।

সৈলুদ্দিন সানা নামে স্থানীয় এক দিনমজুর জানান, ‘লক্ষীখোলা বিলে আমার ২ বিঘা জমি আছে। গত বছর খরচ না ওঠায় এ বছর ফেলে রেখেছি। মাটি কাটার শ্রমিকের কাজ করে জমিতে ধান রোপণের পর যদি খরচ না ওঠে তখন খুব খারাপ লাগে।’

পশ্চিম দেয়াড়ার তৈয়েবুর রহমান নামে এক চা বিক্রেতা বলেন, ‘আমাদের ৪ বিঘা জমি রয়েছে। সেখান থেকে আগে ধান উৎপাদনের ফলে আমাদের বছরের অধিকাংশ খোরাকী হয়ে যেত। তবে বিগত ৩/৪ বছর ফলন ভালো হয় না। খরচও ওঠে না। এ বছর ধান লাগাতে পারিনি।’ 

কয়রার কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতায় ক্ষতি হলেও জেলার চিত্র ভিন্ন। অনাবৃষ্টিতে জেলার নয় উপজেলায়ই দেরিতে ধান রোপণ করতে পেরেছেন কৃষকরা। ফুলতলা, তেরখাদা, রূপসা, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, দিঘলিয়া ও দাকোপ উপজেলায় নদীর পানি দিয়ে অধিকাংশ চাষি ধান লাগাতে পারলেও কয়রা-পাইকগাছায় সেটা সম্ভব হয়নি। অনেক কৃষককে শ্যালো মেশিন দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করে আমন রোপন করতে হয়েছে। ফলে তাদের খরচ বেড়েছে। দেরিতে চাষ করায় ফসল ঘরে তুলতে এখনও এক থেকে দেড় মাস সময় লাগবে তাদের।

এরই মধ্যে বিভিন্ন পোকার আক্রমণে শঙ্কায় রয়েছেন চাষিরা। তবে জেলার ১০/১২৫ শতাংশ চাষির ধান কর্তনের উপযুক্ত হয়েছে।

দাকোপের চুনকুড়ি বিলে ২ বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করেছেন অপূর্ব সরদার। তিনি বলেন, ‘পানির অভাবে দেরিতে ধান রোপন করি। প্রথমবারের বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। ফের বীজতলা তৈরি করে দেরিতে ধানের চারা রোপণ করি। ধানে থোড় আসছে। তবে কারেন্ট পোকায় ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বিঘা প্রতি (৩৩ শতক) ১২/১৩ মণ ধান পাওয়া যেতে পারে।’

রূপসার নৈহাটী ও চর শ্রীরামপুর বিলের আব্দুল মান্নান, সুলতান, সেলিমসহ কয়েকজন চাষি জানান, অনাবৃষ্টির ফলে ভৈরব নদের পানি দিয়ে ধান চাষ করেছেন। কিছু চাষি ধান কাটা শুরু করেছেন। মোটামুটি ফলন পাচ্ছেন তারা। তবে দেরিতে ধান রোপণ করা কিছু জমিতে পোকা লাগায় ফলন নিয়ে চিন্তিত তারা।

পাইকগাছার কপিলমুনি ইউনিয়নের মাইতখালী বিলের ৭ বিঘা জমিতে আমন চাষ করেন ইমদাদুল জোয়ার্দার। তিনি বলেন, প্রথমে খরায় মারা যায়, পরে অতিবৃষ্টিতে ডুবে মারা যায়। শ্যালো মেশিন চালিয়েও ধান রক্ষা করতে পারিনি। ৩ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি চার বিঘায় কোনো রকমে ৩০/৪০ মণ ধান পেতে পারি। 

পাইকগাছা উপজেলার কিছু এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অধিকাংশ জমিতে পানির সমস্যায় ধান ভালো হয়নি। খরায়ও চারা মরেছে, আবার অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় নষ্ট হয়েছে। ধানে ফুল ও থোড় আসা শুরু করেছে। কারেন্ট পোকা, মাঝড়া পোকাসহ বিভিন্ন পোকার আক্রমণে ধানে ক্ষতি হচ্ছে।

কয়রা উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা অসিম কুমার দাস বলেন, আলোর ফাঁদের মাধ্যমে কারেন্ট পোকাসহ কিছু পোকা আক্রমণের সত্যতা পেয়েছি। পোকা দমনে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

দাকোপের কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান খান বলেন, কারেন্ট পোকা প্রতিবছরই লাগে। এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমরা নিয়মিত কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।

খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ৯৩ হাজার ১৮৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৩২৩২ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড জাত, ৭৩,১৬৬ হেক্টরে উফশী ও ১৬,৭৮৭ হেক্টরে স্থানীয় জাতের ধান রোপণ করেছেন কৃষকরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মো. মোছাদ্দেক হোসেন বলেন, ‘পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এবং কৃষকদের সচেতন করতে করণীয় সম্পর্কিত লিফলেট বিতরণ ও উঠান বৈঠক চলমান রয়েছে।’