সারা বাংলা

প্রতিরোধের ‘চরম মূল্য’ দিতে হয়েছিল চড়ারহাট বাসীকে

১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর। গরুর গাড়িতে করে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট ক্যাম্প থেকে বিরামপুরে যাচ্ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা। খবর পৌঁছে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। এরপরই মুক্তিযোদ্ধারা বিরামপুরের আলতাদীঘি–সংলগ্ন বিজুল বাজার এলাকায় হামলা চালান  পাক বাহিনীর ওপর। দুই পক্ষের লড়াইয়ে মারা যান দুই পাকিস্তানি সেনা। এর এক দিন পরেই হামলার ওই ঘটনার চরম মূল্য পরিশোধ করতে হয় চড়ারহাট গ্রামবাসীকে।

১০ অক্টোবর বিজুল বাজার আক্রমণের পরিকল্পনা করে পাকিস্তানি বাহিনী। কিন্তু তারা ভুল করে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার  পুটিমারা ইউনিয়নের চড়ারহাট গ্রামে পৌঁছে যায়। এরপর এই গ্রামে আক্রমণ করে নারকীয় গণহত্যা চালায় তারা। পাকিস্তানি বাহিনীর ব্রাশ ফায়ারে ওই মারা যান ৯৮ জন নিরীহ গ্রামবাসী। এখানেই খান্ত হয়নি তারা।  চলে যাওয়ার সময় জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি ও ফসলের খেত। 

পরের দিন ১১ই অক্টোবর সকালে গ্রামে বেঁচে থাকা কয়েকজন বৃদ্ধ ও আশেপাশের গ্রামবাসী কাফনের কাপড় ছাড়াই চাদর, শাড়ি, জামা ও কাঁথা দিয়ে নিহত সব শহীদদের চড়ারহাট (প্রাণকৃষ্ণপুর) এলাকায় গণ কবর দেন। 

চড়ারহাটের সেই নির্মম গণহত্যার অনেক প্রত্যক্ষদর্শীই এখনো বেঁচে আছেন। সেই স্মৃতির কথা মনে হতেই চোখের কোণে পানি জমে তাদের।  বিশেষকরে প্রাণকৃষ্ণপুর, আন্দোল, সরাইপাড়া, নয়াপাড়া, বেড়ামালিয়া, আহমেদনগর, নওদাপাড়া, শিবরামপুর, চৌঘরিয়া, আমতলা, চন্ডিপুর গ্রামের মানুষরা ওই স্মৃতির কথা আজও ভুলতে পারেননি।

প্রত্যক্ষদর্শী চড়ারহাটের (প্রাণকৃষ্ণপুর) পার্শ্ববর্তী আমশাম গ্রামের আসাদ আলীম ঘটনার স্মৃতিচারণ করে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‌‘যুদ্ধ চলছে। ভোরে জানতে পারি পাকবাহিনী চড়ারহাট গ্রাম ঘেরাও করেছে। আমরা ভয়ে কেউ সেখানে যেতে পারিনি। পরে অনেক গুলির শব্দ শুনতে পাই। পাকবাহিনী চলে যাওয়ার পর ওই গ্রামে গিয়ে দেখতে পাই রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। কি করুন দৃশ্য। লাশের উপর লাশ। সেদৃশ্য বলে বুঝানো যাবে না।'

অপর প্রত্যক্ষদর্শী আসমান আলী বলেন, ‌‘সেদিনের কথা কি আর বলবো। মনে পড়লে আজও লোম শরীরে উঠে দাঁড়ায়। পাক বাহিনীরা তাদের গরুর গাড়ির কাছে আমাকে দাঁড়ি করিয়ে রাখে, ভয়ে আমার জীবন শেষ, আজ হয়তো মরতে হবে তাদের হাতে। পরে দেখি গ্রামের সবাইকে একত্রে করে গুলি করতে থাকে। সবাই মারা যায়, পরে আশেপাশের মানুষদের নিয়ে এই স্থানে নিহতদের কবর দেই।

তিনি আরো বলেন, ওতো মানুষের জন্য কবর খোড়া সম্ভব ছিল না। তাই একটা কবরে দুই থেকে তিনটা করে লাশ রেখে দাফন করা হয়েছে।’

পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে আহত মোজাম্মেল হক নির্মমতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘সেদিন ভোরে মাটি কাটার কথা বলে গ্রামের সব পুরুষকে এক স্থানে একত্রে করে। পাক বাহিনীর সদস্যরা আমাদের ঘিরে রাখে। এরপরই তিন দিক থেকে জানোয়ারগুলো আমাদের উপর নির্মমভাবে গুলি চালাতে থাকে। আধাঘণ্টা ধরে তারা আমাদের উপরে তাণ্ডব চালায়। ১০০ জনের বেশি মানুষ আমরা ছিলাম।অধিকাংশ মানুষই মারা যায়। আমার শরীরে দুইটি গুলি লাগে। আল্লাহপাক আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘পাকবাহিনী চলে যাওয়ার পর সব লাশ পুরাতন কাপড় দিয়ে দুই /তিন জন করে কবর দেওয়া হয়। সেই দিনের নির্মম নির্যাতনের দৃশ্যগুলো আজও চোখে ভাসে।’