সারা বাংলা

একটি পাকা বাড়ির দাবি বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরবালার

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ী ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী মাধবপুর। এই গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন যতিন্দ্র চন্দ্র মল্লিক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই গ্রামের অনেকেই শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে যান। কিন্তু স্ত্রী সুরবালার কোলে চার মাসের সন্তান থাকায় পরিবার নিয়ে ভারত যেতে পারেননি তিনি।  ঘরে তালা দিয়ে তাই স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে গাজীপুরের কালীগঞ্জের এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন তারা। 

সেখানেই একদিন সুরবালার স্বামী যতিন্দ্র চন্দ্র মল্লিক বলেন, মুক্তিবাহিনী ঢুকায় পাক-সেনাদের আক্রমণ কমে এসেছে। সেনারা ক্যাম্প থেকে বের হচ্ছে না। তাই দ্রুত কালীগঞ্জ থেকে ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে শ্রীপুরের মাধবপুর গ্রামে ফিরে আসেন তারা।  শীতের কুয়াশাছন্ন সকাল পাড় হয়ে দুপুর গড়িয়েছে। সুরবালা ঘরের মেঝেতে বসে ছোট্ট মেয়েকে  দুধ খাওয়াচ্ছিলেন।  হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের বুটের আওয়াজে আঁতকে ওঠেন সুরবালা। কোলের শিশু সন্তানকে ছুড়ে ফেলে খালি বাড়ি থেকে সুরবালকে ধরে নিয়ে যায় পাক সেনারা। নিজেকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে পাক বাহিনীর কাছে নির্যাতনের শিকার হন তিনি।

যুদ্ধের সেইসব দিনের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে নিজের বাড়িতে বসে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে এসব কথা বলছিলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

এখন আর স্বাভাবিকভাবে চলতে ফিরতে পারেন না সুরবালা। ছয় বছর আগে বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির উঠানে পা পিছলে পড়ে যান তিনি। তখন থেকেই চলতে-ফিরতে কোমরে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করেন। পরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোমরের চিকিৎসা চলে তার। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। অর্থের জোগান দিতে না পারায় এক সময় সুরবালার চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও গায়ে বাসা বেঁধেছে ডায়াবেটিসসহ উচ্চ রক্তচাপ। চোখেও কম দেখেন, কথাও বলেন ধীরে ধীরে। বাড়িতে ছোট ছোট তিনটি মাটির ঘর। তার একটিতেই থাকেন এই নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরবালা। অন্যের কাঁধ আর লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে হয় তাকে। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরবালা বলেন, ‘যুদ্ধের ৫০ বছর পর স্বীকৃতি পেয়েছি। কিন্তু এখন টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় থাকতে হচ্ছে আমাকে। আমি আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে অনুরোধ করছি। একই সঙ্গে আমাকে নতুন একটি পাকা ঘরেরও যেন ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।’

সুরবালা বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আমার বড় মেয়ের বয়স তখন ছয়-সাত মাস। সেসময় পাক সেনারা আসলে আমরা অন্যখানে চলে যেতাম, লুকিয়ে থাকতাম। আমরা বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সেনাদের হামলা-নির্যাতনের খবর পাচ্ছিলাম। শ্রীপুর কলেজ এলাকার (বর্তমানে শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী কলেজ) মধ্যে অনেক হিন্দু-মুসলমান হত্যা করেছিল শত্রুরা।’

তিনি বলেন, ‘তখন আমার বাড়িতে ছিল একটিমাত্র মাটির ঘর। ওই  ঘরের দরজা বলতে একটা বাঁশের বেড়া ছিল। দুপুরে খাওয়ার পর স্বামী যতিন্দ্র বাইরে যান। আমি ঘরের বেড়াটি চাপিয়ে মেঝেতে বসে মেয়েকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। পাশেই বসেছিল আমার তের-চৌদ্দ বছর বয়সী ভাসুরের মেয়ে।  হঠাৎ করেই ঘরের পাশের রাস্তায় কয়েকজনের বুটের আওয়াজ পাই। রাজাকাররাও আসে। আমি মেয়েকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়াই। তার মধ্যেই তিনজন পাকিস্তানি সেনা বেড়ায় লাথি মেরে ঘরে ঢুকে পড়ে। আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে। শিশু মেয়েটাকে আমার কোল থেকে বিছানায় ছুড়ে ফেলে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। আমার মেয়েটি চিৎকার করে ওঠে।  কিন্তু ওরা জোর করে চুলের মুঠি টেনে আমাকে ও ভাসুরের মেয়েকে বাইরে নিয়ে যেতে চায়। পরে বাড়িতে ঢোকার মুখে জাম গাছ জড়িয়ে ধরে নিজেকে ও ভাসুরের মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। আর তখন আমার কানে শুধু সেই নাড়ি ছেড়া ধনের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল। অনেক চেষ্টা করেও আমি আমার মেয়ের কাছে যেতে পারিনি।’   সুরবালা বলেন, ‘যখন জাম গাছ আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা করছিলাম, তখন পাকিস্তানি সেনারা রাইফেলের বাট দিয়ে আমার কোমরে, পায়ে আঘাত করে ওরা।  রক্ত বের হচ্ছিল। হাতের মধ্যে রাইফেল দিয়ে আঘাত করার পর আর আটকাতে পারে নাই। পরে ওরা আমাদের নিয়ে যাই।  ওরা আমাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালাই।’ 

সুরবালার স্বামী মারা যান ১৯৮৬ সালে। অভাব-অনটনের মধ্যে দিন গেলেও সুরবালা কোনোদিন কারও কাছে গিয়ে সাহায্য চাননি। পড়াশোনা না জানায় সরকারি দপ্তরে যোগাযোগ বা কোনো আবেদনও করেননি। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, ছেলে রিপনকেও বিয়ে করিয়েছেন। রিপনের তিন মেয়ে নিয়েই সুরবালার সংসারে থাকেন। বর্তমানে পুরনো জীর্ণ  এক কক্ষ বিশিষ্ট তিনটি এক চালা মাটির ঘরেই ছেলের পরিবার ও নাতীদের নিয়ে বসবাস সুরবালার। অনেক মুক্তিযোদ্ধারাই পাঁকা বাড়ি পেয়েছেন। একটি পাঁকা বাড়ি দাবি জানান সুরবালা।

বৃষ্টির মধ্যে উঠানে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি বৃষ্টিতে আছাড় খেয়ে উঠানে পড়ে গিয়ে কোমড়ে ব্যথা পেয়েছিলাম। এখনো আমাকে ভুগতে হচ্ছে। মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ওষুধ কিনে খেতে হয়। ভাতার টাকা যা পাই তা দিয়ে কোনো মতে ওষুধের যোগান চলে। কোমড়ে ব্যথার চিকিৎসা করাতে ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। কিন্তু চিকিৎসকরা দেশের বাইরে নিয়ে  অপারেশনের কথা বলেছেন কিন্তু সেই সামর্থ্য আমার নেই। সরকারের পক্ষ থেকে যেন আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা এ এলাকায় সাত-থেকে আটটির মতো ক্যাম্প করেছিল। তার একটি ছিল ইজ্জতপুর রেলসেতুর কাছে। সুরবালা ও তার ভাসুরের মেয়েকে সেই ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যায় তিন পাক সেনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের ক্যাম্পে না নিয়ে ইজ্জতপুর হাইস্কুলের একটি কক্ষে নিয়ে যায় তাদের। সেখানেই তারা নির্যাতিত হন। সন্ধ্যায় গ্রামের লোকেরা বিষয়টি জানতে পেরে ক্যাম্পের দিকে যান। এটা দেখে তিন পাকিস্তানি সেনা তাদের ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। এই ঘটনার পর গ্রামে যে কয়টি ঘর হিন্দু পরিবার ছিল তারাও রাতারাতি এলাকা ছেড়ে দেয়। 

সুরবালাও নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে ফেলেন। সামাজিকভাবে তারা খুব বেশি একটা মানুষের সঙ্গে মিশতেন না। দেশ স্বাধীনের পর ঘটনা চাপিয়ে রেখেই সুরবালার ভাসুরের বীরঙ্গনা মেয়ের বিয়ে হয় নরসিংদীতে।  পরে তিনি স্বামীর সঙ্গে ভারতের কুচবিহারে চলে যান। সেখানেই তারা এখনও বসবাস করছেন।  

সুরবালাকে নির্যাতনের বিষয়টি যুদ্ধ থেকে ফিরেই জানতে পরেছিলেন মো. আবুল হাসেম আকন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এখন রাজাবাড়ি ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার। তিনি  বলেন, ‘নির্যাতনের পর থেকেই সুরবালা নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন, প্রকাশ্য আসতেন না তিনি। তার কথা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রবীণ ব্যক্তিরাও জানতেন। তখন লোকলজ্জার ভয়ে কেউ এ নিয়ে কোনো কথা বলতো না ফলে উনাকে সহযোগিতার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সবার চেষ্টায় তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এখন উনার শরীর খারাপ, তার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন।

সুরবালার ছেলে রিপন চন্দ্র মল্লিক বলেন, ‘পারিবারিক অবস্থা খারাপ দেখে ২০১৯ সালে রাজাবাড়ি ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল হাসেম আকন্দ আবেদন করতে বলেন। তখন সুরবালা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহানা আক্তারের কাছে আবেদন করেন। পরে ইউএনও এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এসে সরেজমিন তদন্ত করেন, গ্রামের মানুষদের সাক্ষ্য নেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সুরবালা রায়কে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। এখন তিনি ভাতাও পাচ্ছেন। এ বছর বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে (মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে) সম্মাননাও পেয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত গ্যাজেটের ২৫৬১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ৩২৮ নম্বর ক্রমিকে তার নাম রয়েছে। গ্যাজেটে তার মুক্তিযোদ্ধা নম্বর- ০১৩৩০০০৫৯০৭।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি অটোরিকশা চালিয়ে মায়ের যাবতীয় খরচ চালাতাম। সরকারের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত মাসিক ভাতা জমিয়ে মাকে একটি পাঁকা ঘর করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। সম্প্রতি একটি অজ্ঞাত প্রাইভেট কার রাজেন্দ্রপুর এলাকায় আমার অটোরিকশাকে চাপা দেয়। এতে আমার ডান হাত ভেঙ্গে যায়। পরে ঢাকাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা করালে ভাতা থেকে সঞ্চয়ের পুরো টাকাই খরচ হয়ে গেছে। আরও আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে চিকিৎসা করানো হচ্ছে। এখন চিকিৎসক দুই মাসে ছুটিতে পাঠিয়েছেন। ভাঙ্গা হাত নিয়ে এখন কাজে যাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের কাছে সহযোগিতাসহ মায়ের স্বপ্ন পূরণে একটি পাঁকা বাড়ির আবেদন জানাচ্ছি।’

শ্রীপুরের ইউএনও মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরবালার ঘরের আবেদন এরই মধ্যে সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর চিকিৎসার ব্যাপারেও তাকে সহযোগিতা করা হবে।’

গাজীপুরে জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শাহনাজ আক্তার (ভারপ্রাপ্ত) বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীনে সুরবালা মতো অনেক নারী বীর মুক্তিযোদ্ধারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে খোঁজ খবর নিয়ে তার সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করবো।’