সারা বাংলা

কৃষিতে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়, মিলছে না ন্যায্যমূল্য

জ্বালানি তেল, সার-কীটনাশকসহ সব ধরনের কৃষি সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষিতে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। তবে এর বিপরীতে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না বলে দাবি দেশের উত্তরের জনপদ গাইবান্ধার কৃষকদের।

কৃষকরা বলছেন, খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষিপণ্য উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে। উৎপাদন বেশি হলেও ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।

কৃষকদের অভিযোগ, প্রতিনিয়ত জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কৃষিকাজে উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও কোনোভাবেই কৃষক পর্যায়ে তাদের ফসলের দাম বাড়ে না। গেলো বছরে বোরো মৌসুমের ধান চাষে সেচ খরচ ছিল বিঘাপ্রতি ১ হাজার ২০০ টাকা। এবছর ৪০০ টাকা বেড়ে তা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকায়। প্রতি কেজি ধানের বীজে দাম বেড়েছে প্রায় ২০০ টাকা। এছাড়া জমি চাষের খরচ ৯০০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০ টাকা। একইভাবে চাষের খরচ বেড়েছে ভুট্টা, আলু, সরিষাসহ অন্য ফসল রোপণ ও উৎপাদনে। সেইসঙ্গে যোগ হবে কীটনাশকের বাড়তি খরচও।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপড়হাটী ইউনিয়নের কৃষক আমিরুল ইসলাম। তার পরিবারের আয়ের উৎস কৃষিকাজ। তবে গেলো বছরের মাঝামাঝি ডিজেল ও চলতি বছরে দুই দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এবার বোরো মৌসুমে চাষাবাদে খরচ বাড়বে তার। এজন্য বোরো ধান চাষ করবেন কী না, এ নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন আমিরুল ইসলাম। একই অবস্থা এই অঞ্চলের হাজারো কৃষকের।

কৃষক আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবছর ১০ বিঘা জমিতে বোরো ধান রোপণ করি। তবে সারের দাম এখন বেশি। এরই মধ্যে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে তাহলে কীভাবে জমিতে সেচ দেবো? দেখি চিন্তা করে খরচের সঙ্গে মিললে বোরো ধান চাষ করবো, না হলে করবো না।’

বেলকা ইউনিয়নের পঞ্চানন পলাশতলা গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমার সংসারের সব খরচ চলে কৃষি থেকে উৎপাদিত শস্য বিক্রি করে। তবে দিনদিন যে হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে সে তুলনায় বাড়েনি ফসলের দাম।’

তিনি আরও বলেন, গেল বছর ১৫ বিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছিলাম। খরচ বেশি হওয়ায় এবারে আট বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছি। সার তো ন্যায্য মূল্যে পাওয়া যায় না। হিসাব করে দেখলাম যে ভুট্টা ভাঙা পর্যন্ত যা খরচ হবে তা দিয়ে খরচের টাকাই উঠবে না।’

বেলকা ইউনিয়নের নবাবগঞ্জ গ্রামের বর্গাচাষী আমজাদ হোসেন বলেন, ‘হামরা তিস্তার চরোত ভুট্টা, মরিচ, আলু, পিয়াজসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করি। ৩/৪ দিন পর পর পানি দেয়া লাগে। তেলের দাম বাড়ায় এখন হামার খরচে ওঠে না।’ 

একই গ্রামের শরিফুল ইসলাম নামের অপর এক কৃষক বলেন, ‘হামার জমিত ৩/৪ দিন পর পর পানি দেয়া লাগে৷ ভুট্টাত ৮/৯ বার করি পানি দেই। অন্যের মেশিন থাকি জমিত পানি দেই। তেলের দাম বেশি হওয়ার পর থাকি এক ঘণ্টা পানি দিলে ২০০-২২০ টাকা করি নেয় মেশিন এলারা৷ এতো দাম দিয়ে পানি দিয়ে হামার খরচে ওঠপের নয়। জমিও তো ফেলে থুইবার পাই না।’

তালুক বেলকা গ্রামের রয়েল সরকার নামের এক তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা আক্ষেপ করে বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম বাড়ছে, জ্বালানি তেলেরও দাম বাড়ে, শুধু কৃষকদের ফলানো পণ্যের দাম বাড়ে না। এভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকলে তরুণ উদ্যোক্তারা আর কৃষি চাষাবাদের দিকে ঝুঁকবে না।’

তিস্তার চরের শ্যালো মেশিন চালক কালাম মিয়া বলেন, ‘আগে ৮২ টাকায় ডিজেল কিনে এক ঘণ্টা সেচ দিয়ে ১৫০-১৭০ টাকা নিতাম। এখন ১২০ টাকায় তেল কিনে ওই দামে আর পোষাবে না। তাই ঘণ্টায় ২০০-২২০ টাকা করে নিতে হবে। এতে কৃষকদের খরচ বেশি পড়বে, ফসল বিক্রি করে কৃষকদের আসল টাকাই উঠবে না৷’

তারাপুর ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল জব্বার বলেন, ‘এবার আমার আলুর ফলন ভালো হয়েছে। তবে আমরা ন্যায্য দাম পাচ্ছি না। উৎপাদন খরচ তো ওঠেনি উল্টো লোকসান হয়েছে।’

গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘সার ও ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে কিছুটা প্রভাব পড়বে। তবে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবেন কৃষকরা। তাছাড়া সরকার বিভিন্ন সময় কৃষকদের বিনামূল্যে সার-বীজ দিচ্ছে। কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান সে বিষয়ে মনিটরিং করে যাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘কৃষকরা সাধারণত একযোগে সবাই শস্য বিক্রি করে থাকেন। আবার যারা শস্য কিনে মজুদ রাখেন তারা ঠিকই দাম পান। কৃষকরা যদি মজুত রেখে বিক্রি বা একটু দেরি করে বিক্রি করেন তারাও ন্যায্য দাম পাবেন। এক্ষেত্রে তাদের কিছুটা কৌশলী হতে হবে।’