২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায়কে কেন্দ্র করে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা।
এসময় উপজেলার বামনডাঙ্গায় ব্যাপক ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বন্দরে দোকানপাট, বাড়ি-ঘর, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ও রেলস্টেশন জ্বালিয়ে দেয়। রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়। এমনকি সুন্দরগঞ্জ-বামনডাঙ্গা সড়কের কয়েক হাজার গাছ কেটে রাস্তা অবরোধ করে দুর্বৃত্তরা। তাদের নারকীয় তাণ্ডবে বাদ যায়নি দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা। তাদের নির্মম পিটুনিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের চার পুলিশ সদস্য।
নিহত চার পুলিশ সদস্য হলেন- গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার খামার ধনারুহা গ্রামের খাজা নাজিম উদ্দিন, রংপুরের পীরগাছা উপজেলার রহমতের চর গ্রামের তোজাম্মেল হক, কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার কিশামত গোবধা গ্রামের হজরত আলী ও বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামের বাবলু মিয়া।
চার পুলিশ হত্যার দশ বছর পূর্ণ হয়েছে আজ (২৮ ফেব্রুয়ারি)। এমন লোমহর্ষক ঘটনার আজও শেষ হয়নি বিচার কাজ। চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলায় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ২৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। এর মধ্যে একজন শিশুও ছিল।
এ মামলায় বাদি ও সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। চাঞ্চল্যকর এ মামলায় মোট ৭৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। বাকি আছে আরো ৪৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ। মামলাটি অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু গত তিন চার বছর অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক না থাকা ও মহামারী করোনাকালের জন্য কোন অগ্রগতি হয়নি। নিহতের স্বজন ও স্থানীয়রা দ্রুত বিচার কাজ শেষ করে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে চান।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আরিফুল ইসলাম রাসেল বলেন, ‘চার পুলিশ হত্যার ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও পুলিশ হত্যা মামলা বিচার কাজ এখনো শেষ হয়নি। আসামিরা বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করছেন। শুনেছি মামলার অনেক সাক্ষীই নানা অজুহাতে আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছেন না। এ কারণে বিচার শেষ হতে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তবে আলোচিত এই মামলার বিচার কাজ দ্রুত নিস্পত্তির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষীগ্রহণ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া দরকার।'
চার পুলিশ হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক প্রভাষক আব্দুল্লাহ আল মেহেদী রাসেল বলেন, ‘আমি আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছি। মামলার সাক্ষী হওয়ায় বিভিন্ন হুমকিতে রয়েছি। আমাকে কয়েকবার হত্যার হুমকিও দিয়েছে। এখন আসামিরা জামিনে মুক্ত হয়ে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকি অনেক আসামি ইউপি চেয়ারম্যানও হয়েছেন। আশা করি দ্রুত সময়ে মামলার বিচারকার্য শেষ হবে।’
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফারুক আহাম্মেদ প্রিন্স বলেন, ‘চার্জশিট দেয়ার পর মামলাটি জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত থেকে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়। বদলিজনিত কারণে গত কয়েক বছর আদালতে বিচারক ছিলেন না। এছাড়াও মহামারী করোনার কারণে মামলার বিচারকাজ পিছিয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মামলাটি এখন বিচারিক কার্যক্রমে রয়েছে। ২০১৮ সালে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়ে ৭৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহন করেছে আদালত। অভিযুক্তদের মধ্যে ২২৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও তারা সবাই জামিনে মুক্ত। জামিনে মুক্তদের মধ্যে দুইজন পলাতক রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলাকালে ৮ আসামির মৃত্যু হয়েছে। প্রথম থেকেই মূল আসামি সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল আজিজ ওরফে ঘোড়া মারা আজিজসহ ছয়জন আসামি পলাতক থাকায় তাদেরকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। আশা রাখছি দ্রুত মামলাটি নিষ্পত্তি হবে। সেই সঙ্গে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।’
চাকরি পায়নি পরিবারগুলো:
জামায়াত-শিবিরের নারকীয় তাণ্ডবে নিহত পুলিশ পরিবারগুলো যেমন স্বজন হারানোর বিচার পায়নি, তেমনি সরকারের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চাকরি পায়নি তারা। একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন পরিবারগুলো। মাস শেষে পেনশনের সমান্য টাকায় কোন রকম সংসারের চাকা সচল রেখেছে। আর্থিক অনিশ্চয়তায় কেউবা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম হতাশায় রয়েছেন। কিন্তু এসব ঘটনার পরপরেই নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় তিনি পরিবারগুলোকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এতে যোগ্যতা অনুযায়ী পুলিশ পরিবারের প্রত্যাককে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ সংক্রান্ত একটা অনুশাসন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পুলিশ বিভাগে পাঠানো হয়। কিন্তু সংগত কোন কারণে সরকারের সেই অনুশাসন ফাইলবন্দী রয়ে গেছে। হত্যাকাণ্ডের ১০ বছরে এসে এখন পর্যন্ত সেই অনুশাসন বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশ পরিবারগুলো।
নিহত পুলিশ পরিবারগুলোর অভিযোগ, প্রতিবছর এই দিনটি আসলেই শুধু তাদের স্মরণ করে জেলা পুলিশ। পুলিশ হত্যা দিবসের অনুষ্ঠান শেষ হলে আর কখনো তাদের খোঁজখবর নেওয়া হয় না। পরিবারগুলোর দাবি, একবারের জন্য হলেও যেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেন। তাদের কষ্টের কথাগুলো প্রধানমন্ত্রীকেই শুনাতে চান। চাকরি না পেলেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে তাদের দুঃখের কথা বলতে চান একটি বারের জন্য।
নিহত চার পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একজনের চাকরি মিললেও বাকি পরিবারগুলোর মধ্যে কনস্টেবল তোজাম্মেল হকের ছেলে আলমগীর হোসেন চাকরি পায়নি। শর্ত অনুযায়ী সাব-ইন্সপেক্টর পদে আবেদন কয়েকবার আবেদন করে বাদ পড়ে যান আলমগীর হোসেন। তারপর চাকরির জন্য শুরু হয় ছোটাছুটি। কখনো এসপি, আবার কখনো ডিআইজির দরজায় কড়া নাড়েন তারা। বাদ যায়নি পুলিশ হেডকোয়ার্টারের এআইজি থেকে অতিরিক্ত আইজিপি। সবার দরজায় কড়া নেড়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়েছে তাদের। চেষ্টা করতে করতে চাকরির বয়স শেষ হয় তার। এরপর আবারও পুলিশে চাকরির চেষ্টা করেন তোজাম্মেল হকের মেয়ে তাজমিন আক্তার। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্ট (এসআই) পদে আবেদন করেন। লিখিত পরীক্ষায় পাস না করায় বাদ পড়েন তিনিও। এরপর এক পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করেন তারা। তিনি সাফ জানিয়ে দেন লিখিত পরীক্ষায় পাস না করলে তার কিছুই করার নেই।
নিহত কনস্টেবল হযরত আলীর সন্তান ছোট থাকায় তার স্ত্রী লায়লা বেগমকে বেসরকারি চাকরির আশ্বাস দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু আশ্বাস মিললেও সে অনুযায়ী লায়লা বেগমের চাকরি মেলেনি আজও। তিনি একমাত্র সন্তানের ভবিষৎ নিয়ে অনেকটা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দশ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হলেও ভাগাভাগি করে পেয়েছেন তিন লাখ টাকা। বাকি সাত লাখ টাকার মধ্যে ৪ লাখ ছেলের নামে ব্যাংকে ডিপোজিট রাখা হয় আর ৩ লাখ টাকা হযরত আলীর মাকে দেওয়া হয়। লায়লা বেগম সেই টাকা সন্তানের পড়াশোনায় ব্যয় করতে করতে তা এখন শূন্যের কোঠায়।
চাকরি মিলেনি নিহত কনস্টেবল নাজিম উদ্দিনের পরিবারেও। তার সন্তানের জন্য চাকরির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে পরিবারটি। তার পরিবারে একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি ছিলেন নাজিম উদ্দিন। তার দুই মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে কারো ভাগ্যে জোটেনি সরকারি চাকরি। ছোট ছেলে ফরিদুল ইসলাম উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার সময় নিহত হন নাজিম উদ্দিন। এরপর পরিবারের হাল ধরতে পড়াশোনা ছেড়ে দেন ফরিদুল। সরকারি চাকরি পেতে তিনিও পুলিশের অনেক বড় কর্মকর্তাদের দ্বারস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। নানা হয়রানির শিকার হয়ে পরিবারটিও আর চাকরি পাওয়ার আশা করেনা।
এ বিষয়ে নিহত কনস্টেবল তোজাম্মেল হকের স্ত্রী আরেফা বেগম প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি। এরপর তিনি বলেন, 'কি হবে আপনাদের বলে? সরকারের পক্ষ থেকে সন্তানদের চাকরির আশ্বাস পেয়েছিলাম। কিন্তু সে আশ্বাস আজও বাস্তবায়ন হয়নি। আমার স্বামী তো দেশের জন্য নিজের জীবন দিয়েছে। তার রক্তের দাম কেউ দেয়নি।’
হযরত আলীর স্ত্রী লায়লা বেগম বলেন, ‘আমি অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়েছি। এখন আমার সম্বল একমাত্র সন্তান ইফতেখার। ওকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখি। পুলিশের পক্ষ থেকে আমাকে চাকরি দেয়ার কথা বলা হলেও আজও তা পাইনি। সামান্য পেনশনের টাকায় সংসার চালাই।’
কনস্টেবল খাজা নাজিম উদ্দিনের স্ত্রী ফিরোজা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী ছিলেন পরিবারের একমাত্র মাথার ছাদ। তার মৃত্যুর পর সন্তানদের নিয়ে অনেক কষ্টে আছি। ঘটনার পর অনেক প্রতিশ্রুতি পেয়েছি, কিন্তু চাকরি পাইনি।’
গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘দশ বছরেও নিহত চার পুলিশ পরিবারের কেউ চাকরি না পাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। ইতোপূর্বে মাননীয় স্বরাস্ট্রমন্ত্রীকে অবগত করেছি। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে আবারও স্বরাস্ট্রমন্ত্রীকে বিষয়টি জানাবো।'