বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর কুষ্টিয়ায় রেকর্ড পরিমাণ ভুট্টার আবাদ হয়েছে। গত বছর অর্থকারী এ ফসলের দাম বেশ ভালো পাওয়া এবং কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের নানা উদ্যোগে বেড়েছে ভুট্টার আবাদ। সেই সঙ্গে আধুনিক জাত ও আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় হেক্টরপ্রতি ফলনও বেড়েছে। এ বছর কুষ্টিয়া জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে বেশি আবাদ হয়েছে ভুট্টার।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের রবি মৌসুমে কুষ্টিয়া জেলার ৬টি উপজেলায় ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯ হাজার ৯১৬ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৫৯৭ মেট্রিক টন। হেক্টরপ্রতি ফলন ছিল গড়ে ১০ দশমিক ৭৫ মেট্রিক টন। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ বছর জেলায় আবাদ হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ হাজার ৩৪ হেক্টর বেশি। উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪২৫ মেট্রিক টন। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ হাজার ৮২৮ মেট্রিক টন বেশি।
আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় হেক্টরপ্রতি ফলন হয়েছে গড়ে ১১ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে শূন্য দশমিক ৭৫ মেট্রিক টন বেশি।
সদর উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, কুষ্টিয়ার সদরে ২৯০৫ হেক্টর, খোকসায় ৬১ হেক্টর, কুমারখালীতে ১২৬৫ হেক্টর, মিরপুরে ২০১৫ হেক্টর, ভেড়ামারায় ৪১৫ হেক্টর এবং দৌলতপুর উপজেলায় ৫ হাজার ২৮৯ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে কুষ্টিয়ার সদরে ৩২ হাজার ৬৮১ মেট্রিক টন, খোকসায় ৭০২ মেট্রিক টন, কুমারখালীতে ১৩ হাজার ৯১৫ মেট্রিক টন, মিরপুরে ২৩ হাজার ১৭৩ মেট্রিক টন, ভেড়ামারায় ৪ হাজার ৮৯৭ মেট্রিক টন এবং দৌলতপুর উপজেলায় ৬২ হাজার ০৫৭ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে।
চাষের ক্ষেত্রে জেলা জুড়ে বেশ আলোড়ন ফেলেছে পাউনিয়ার-৩৩৯৬ জাতের ভুট্টা। যার হেক্টর প্রতি ফলন হয়েছে প্রায় ১১ দশমিক ৯৫ মেট্রিক টন। জেলায় প্রায় ১ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমিতে এ জাতের ভুট্টা চাষ হয়েছিল। এতে প্রায় ২১ হাজার ৫৪১ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে শুধু এ জাতের। এছাড়াও সুপার সাইন-২৭৬০ ও কাবেরী-৫৪ জাতের ভুট্টার বেশি আবাদ হয়েছে।
যা গত বছর এই রবি মৌসুমে চাষ হয়েছিল ৯ হাজার ৮১৬ হেক্টর জমিতে। এ বছর ভুট্টার দাম ভালো পাওয়ায় আগামী মৌসুমে ভুট্টা চাষ আরও চাষ বৃদ্ধি পবে বলে জানিয়েছেন কৃষক ও কৃষি বিভাগ।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার লক্ষ্মীপুর এলাকার কৃষক জালাল উদ্দিন বলেন, ‘এ বছর আমি তিন বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছিলাম। গতবার ২ বিঘা জমিতে চাষ করেছিলাম। দাম ভালো ছিল বলে এবার এক বিঘা বেশি চাষ করেছি। বিঘা প্রতি আমার ১৪-১৫ হাজার টাকা মতো খরচ হয়েছে। ফলন প্রায় বিঘাতে ৪৪-৪৫ (কাঁচা) মণ করে পেয়েছি। কাঁচা ভুট্টা জমি থেকে সংগ্রহ করেই ৮৩০ টাকা মণ হিসাবে বিক্রি করেছি। প্রায় ১ লাখ টাকার উপরে বিক্রি করেছি। যাতে ৪০-৪২ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। অন্য ফসলের তুলনায় ভুট্টায় দ্বিগুণ লাভ হয়। ভুট্টায় খরচ করলে কোনো লস নেই এখন।’
একই এলাকার কৃষক স্বপন আলী বলেন, ‘এ বছর ভুট্টার যে দাম তাতে, তামাকের তুলনায় বেশি লাভ। ২ বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছি। ৬০ হাজার টাকার মতো বিক্রি করেছি। খরচ হয়েছিল সব মিলিয়ে প্রায় ২৮-২৯ হাজার টাকা।’
মিরপুর উপজেলার কৃষক মারুফ জানান, এ বার ভুট্টার ফলনও বেশ ভালো হয়েছে। সারের দাম বেশি হওয়ায় প্রতি বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষে খরচ হয়েছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। আর ফলন হয়েছে প্রতিবিঘা জমিতে ৪৫ থেকে ৫০ মণ পর্যন্ত।
দৌলতপুর উপজেলার মৌসুমী ভুট্টার ব্যবসায়ী বিমান সরদার বলেন, ‘গত বছর থেকে বাইরের জেলা থেকে পাইকারি ভুট্টা ক্রেতারা আসছেন তাই দাম ভালো পাওয়া যাচ্ছে। এ বছর কাঁচা ভুট্টা আমরা কৃষকের কাছ থেকে ৮২০ টাকা থেকে শুরু করে ৮৫০ টাকা দরে মণ হিসাবে এবং ১০০০ থেকে ১০৫০ টাকা মণ হিসাবে শুকনা ভুট্টা কিনছি। মণপ্রতি ১০-২০ টাকা লাভে বিক্রি করে দিচ্ছি।’
দৌলতপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ভুট্টা চাষের খরচ তুলনামুলক কম এবং লাভ বেশি হওয়ায় এ অঞ্চলে ভুট্টার আবাদ দিন দিন বেড়ে চলেছে। আমরা কৃষকদের ভুট্টা চাষে প্রশিক্ষণ এবং সরকারি প্রণোদনা দিয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। সেই সঙ্গে দাম বাড়ার কারণে বেশি আগ্রহী হয়েছে কৃষকরা।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. হায়াত মাহমুদ জানান, চলতি বছরে কুষ্টিয়া জেলা জুড়েই ভুট্টার বাম্পার ফলন হয়েছে। বিগত বছরের তুলনায় এবার আবাদও বেশি। জেলায় ভুট্টা চাষের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার থেকে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে। দামও বেশ ভালো পেয়েছে কৃষকরা। আগামীতে আরও ভুট্টার চাষ বেশি হবে বলে আশা করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, কৃষি প্রণোদনা, ভুট্টা চাষে প্রশিক্ষণ, আধুনিক জাতের সম্প্রসারণের পাশাপাশি লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা বেশি আগ্রহী হয়েছেন ভুট্টা চাষে।