কোরবানির ঈদের আগে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও শাহজাদপুর উপজেলায় গরুর লাম্পি স্কিন (এলএসডি) রোগ দেখা দিয়েছে। এ রোগটির সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক না থাকায় খামারি ও কৃষকেরা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। ইতিমধ্যে জেলার বিভিন্ন উপজেলার বেশ কিছু গরু এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত গরুগুলোকে চিকিৎসা দেওয়া হলেও সংক্রমণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো গরু মারা যায়নি।
অন্যদিকে, গরু লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হওয়ায় কম দামে স্থানীয় কসাইদের কাছে তা বিক্রি করছেন কৃষক ও খামারিরা।
জেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ৯ উপজেলায় প্রায় ১৭ হাজার ছোট বড় খামারি ও কৃষক বিভিন্ন প্রজাতির গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া মোটাতাজা করেছে। এতে খামারে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৩৯৬টি গবাদিপশু মোটাতাজা করা হয়েছে। এর মধ্যে ষাঁড় ১ লাখ ৭১ হাজার ৭১২টি, মহিষ ১ হাজার ৪০৫টি, ছাগল ১ লাখ ৫৫ হাজার ও ভেড়া ৬১ হাজার ১৩৩টি। এ জেলায় কোরবানির জন্য পশুর চাহিদা ১ লাখ ৬০ হাজার। এই চাহিদা মিটিয়ে ২ লাখ ২৬ হাজার ৩৯৬টি পশু সারা দেশে যাবে। এ বছর জেলায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার মোটাতাজা করা গবাদি পশু ক্রয়-বিক্রয় করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে জেলা প্রাণি সম্পদ বিভাগ।
কৃষক ও খামারিদের অভিযোগ, কোরবানি ঈদের আগে এ রোগটি ব্যাপক আকার ধারণ করলেও মাঠ পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে না প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। ফলে গ্রামের কিছু পশু চিকিৎসক দিয়ে চলছে চিকিৎসা। এতে গরু ঠিক মতো সুস্থ হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহাজদপুর তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলায় প্রায় এক হাজারেরও বেশি গরু এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
তাড়াশ উপজেলার তালম ও বারুহাস ইউনিয়নের অধিকাংশ বাড়িতেই এ রোগ দেখা দিয়েছে। ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামের পর গ্রাম। গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির এ পরিস্থিতিতে আক্রান্ত গরুর চিকিৎসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন কৃষক ও খামারিরা।
তালম পদ্মাপাড়া গ্রামের কৃষক জয়নাল শেখ, আলতাব হোসেন জানান, তাদের ৮টি গরুর মধ্যে ২টি বড় গরুর গলার নিচে ফুলে সারা গায়ে ফোসকা বের হয়েছে। গরুর অবস্থা খুব খারাপ। শরীর পচে গর্ত হয়ে যাচ্ছে। সাড়ে ৫ হাজার টাকা খরচ করেও দুইটি গরু সুস্থ হয়নি। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।
শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া গ্রামের কৃষক ইয়ামিন শেখ বলেন, তিন-চার দিন আগে প্রথমে একটি গরুর এ রোগ দেখা দেয়। গরুটির চিকিৎসা চলা অবস্থায় আরও একটি গরু এ রোগে আক্রান্ত হয়। তার খামারে নয়টি গরু আছে। দুটি অসুস্থ হওয়ায় তিনি চিন্তায় আছেন।
তালম পদ্মাপাড়া গ্রামের সামাদ আলী বলেন, পশু হাসপাতালে ঘুরে যাচ্ছি ডাক্তার পাচ্ছি না। এই হাসপাতালে এসে কখনো কাউকে পাওয়া যায় না। এখানে নাকি কোনো ডাক্তার নেই। এ অবস্থায় গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছি।
রায়গঞ্জ উপজেলার চকনূর গ্রামের জামাত আলী, আবু সাইদ ও মংলা শেখ জানান, তাদের প্রত্যেকের একটি করে গরু এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া, এ গ্রামের সিংহভাগ বাড়িতে এ ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে।
জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে শাহজাদপুর, তাড়াশ ও রায়গঞ্জের অধিকাংশের বাড়িতে গরুর দেখা দিয়েছে ‘লাম্পি স্কিন’ রোগ। খামারিদের অভিযোগ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের লোকজনকে খবর দিয়েও পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে গ্রামের পশু চিকিৎসকের কাছে যেতে হচ্ছে। তাদের পরার্মশে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
তাড়াশ উপজেলার পল্লী চিকিৎসক আব্দুল মান্নান বলেন, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে লাম্পি স্কিন রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই কয়েকটি করে এমন রোগে আক্রান্ত গরু দেখছি। তবে এর সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। লক্ষণ দেখে আক্রান্ত পশুকে পেনিসিলিন, এন্টি হিস্টামিন এবং জ্বর হলে প্যারাসিটামল দিলে কিছুটা উপকার পাওয়া যায়।
শাহজাদপুরের পোতাজিয়া গ্রামের পশু চিকিৎসক সাইদুল ইসলাম বলেন, এ রোগে আক্রান্ত হলে গরুর শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফুলে যায়, শরীরে জ্বর হয়। এক সপ্তাহে পোতাজিয়া ও আশপাশের গ্রামের দুই শতাধিক গরু এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। চিকিৎসায় ইতিমধ্যে অর্ধেক ভালো হয়েছে। বাকিগুলোর চিকিৎসা চলছে। তবে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে কোনো গরু মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. গৌরাঙ্গ কুমার তালুকদার বলেন, গরুর লাম্পি স্কিন রোগ ছোঁয়াচে না হওয়ায় দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমরা আশা করছি, কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা গরুতে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। জেলায় তিন বছর ধরে গরুর লাম্পি স্কিন রোগটি দেখা দিয়েছে। বর্ষা মৌসুমে এটি বেশি হয়। আক্রান্ত গরুগুলোকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সাত থেকে আট দিনের চিকিৎসায় আক্রান্ত গরু সুস্থ হয়ে ওঠে।
তবে এ রোগে আক্রান্ত হলে প্রথমেই অসুস্থ গরুটিকে আলাদা করতে হবে। মশারি টাঙিয়ে রাখতে হবে, যাতে মশা বা মাছি গরুর শরীরে না বসে। কেননা মশা বা মাছি অসুস্থ গরুটিকে কামড় দিয়ে যদি সুস্থ কোনো গরুকে কামড়ায় তাহলে সেটিও অসুস্থ হয়ে পড়বে। এ রোগের ফলে মূলত গরু অসুস্থ হয়ে পড়ে। গায়ে গুটি গুটি ফোড়ার মতো হয়ে পেকে পুঁজ বের হয়। এ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে প্রত্যেক উপজেলায় ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম চলমান আছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।