সারা বাংলা

ইলিশে ভরপুর বরগুনার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, দাম নাগালের বাইরে

চলছে ইলিশের ভরা মৌসুম। সমুদ্র এবং নদীতে জেলেদের জালে ধরা পড়ছে প্রচুর সংখ্যক ইলিশ। ক্রেতাদের অভিযোগ বাজার সিন্ডিকেটের কারণে নাগালের বাইরে রয়েছে ইলিশ। তবে, মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, রসদ ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বেশি দামে ইলিশ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। 

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইলিশের ভরা মৌসুম বলা হয়। বছরের বাকি ৯ মাস থেকে এই তিন মাস প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ে জেলেদের জালে। 

রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) দেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বরগুনার পাথরঘাটার বিএফডিসি ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৩০টি ট্রলার ঘাটে ভেড়ানো অবস্থায় রয়েছে। ঘাটের পাশে নোঙর করে আছে আরও অন্তত অর্ধশতাধিক ট্রলার। ঘাটে ভেড়ানো ট্রলার থেকে মাছ নামানো হচ্ছে অবতরণ কেন্দ্রে। ইলিশে সয়লাব এই অবতরণ কেন্দ্রটি। 

এফ বি সুবর্ণা ট্রলার মৎস্য ঘাটে এসেছে ৫৬ মণ মাছ নিয়ে। তাদের নিয়ে আসা মাছের মধ্যে ৩৮ মণই ইলিশ। বাকি ১৮ মণ অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ। 

ট্রলারের মাঝি লায়ন হাওলাদার রাইজিংবিডিকে জানান, গত ২৩ আগস্ট রাতে মাছ শিকারের জন্য পাথরঘাটার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাট থেকে সাগরের উদ্দেশ্যে রওনা করা হয়। ২৭ আগস্ট দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে ৭৮ কিলোমিটার দূরে গিয়ে ৬ বার জাল ফেলেন তারা। এসময় বিপুল পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ে তাদের জালে। ইলিশের সঙ্গে অন্যান্য সামুদ্রিক মাছও পেয়েছেন তারা। 

তিনি আরও বলেন, ‌সাগরে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধিতে সরকারের নানা উদ্যোগের কারণেই বেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে। সাগর ও নদী মোহনায় অবৈধ জালের ব্যবহার বন্ধ করতে পারলে মাছের পরিমাণ আরো কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে।

বরগুনার পাথরঘাটার বিএফডিসি ঘাটে আসা বেশিরভাগ ট্রলারে ১৫ থেকে ৩০ মণ পর্যন্ত ইলিশ রয়েছে। এর সাথে রয়েছে অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ। এফ বি তুষার, এফ বি মায়ের দোয়া, এফ বি নাজমা, এফ বি এনামুলসহ একাধিক ট্রলারের জেলেরা রাইজিংবিডিকে বলেন, সাগরে মাছ শিকার করতে গিয়ে মোটামুটি সবাই আশানুরূপ মাছ পাচ্ছে।

মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে নদীর ইলিশের পাইকারি মূল্য: মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে নদীর এক কেজি ও এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬২ হাজার টাকা মণ, যা গত ইলিশ মৌসুমে ছিল ৫০ থেকে ৫২ হাজার টাকা। ৭০০ থেকে ৯৯৯ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৩ হাজার টাকায়, যা গত ইলিশ মৌসুমে ছিল ৪০ থেকে থেকে ৪২ হাজার টাকা। ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকায়, যা গত ইলিশ মৌসুমে ছিল ৩৮ থেকে ৪০ হাজার টাকা। ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩২ থেকে ৩৬ হাজার টাকায়, যা গত ইলিশ মৌসুমে ছিল ২৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা।

মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে সাগরের ইলিশের পাইকারি মূল্য: এক কেজি ও এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ হাজার টাকা মণ, যা গত ইলিশ মৌসুমে ছিল ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকা। ৭০০ থেকে ৯৯৯ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকায়, যা গত ইলিশ মৌসুমে ছিল ৩৫ থেকে থেকে ৩৭ হাজার টাকা। ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩৬ থেকে ৪০ হাজার টাকায়, যা গত ইলিশ মৌসুমে ছিল ২৯ থেকে ৩১ হাজার টাকা। ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ২৮ হাজার টাকায়, যা গত ইলিশ মৌসুমে ছিল ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা।

খুচরা বাজারে ইলিশের চড়া দাম: বরগুনার ৬ উপজেলা সদর, পাথরঘাটা, বামনা, বেতাগী, আমতলী ও তালতলী উপজেলার মাছ বাজারগুলোতে ঘুরে খুচরা ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইলিশসহ সামুদ্রিক ও নদীর সব মাছের দাম মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে। বরগুনার মাছ বাজারে এক কেজি ও এক কেজি বেশি ওজনের নদীর ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা কেজি দরে। যা গত ইলিশ মৌসুমে বিক্রি হয়েছে ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায়। ৭০০ থেকে ৯৯৯ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা কেজি, যা গত ইলিশ মৌসুমে ছিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১১৫০ টাকা, যা গত ইলিশ মৌসুমে ছিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকা, যা গত ইলিশ মৌসুমে ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।

বরগুনা সদরের মাছ বাজারে ক্রেতা অধ্যাপক জামান হোসেন বলেন, ‌আমরা উপকূলীয় জেলার মানুষ। অথচ আমরাই ইলিশের ভরা মৌসুমেও ইলিশ খেতে পারি না। গত বছরের থেকে এ বছর মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে ইলিশের দাম। অন্যান্য যে কোনো মাছের তুলনায় এই মাসের দামটাই বাড়তি। হতদরিদ্রদের কথাতো দূরে মধ্যবিত্তদেরও ক্রয়ের ক্ষমতার বাইরে ইলিশ। 

পাথরঘাটা খুচরা মাছ বাজারের ক্রেতা অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম বলেন, পাথরঘাটার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে পাইকারি বিক্রি হয় মাছ। তাই আমরা খুচরো বাজার থেকেই মাছ কিনি। ইলিশের দাম এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে এই মাছের দাম জিজ্ঞাসা করতেও ভয় লাগে। মৎস্য ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পুরো জেলা জুড়ে মাছের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বাজার মনিটরিং কমিটি কোনো কাজ করছে না। এ কারণে এই সিন্ডিকেট পুরো বরগুনার মাছ বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। 

বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, মৎস্যজীবীদের কোন সিন্ডিকেট নেই। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে মাছের দাম। একটি ট্রলার সাগরে মাছ শিকারে গেলে ১৮ জন জেলের খাবার, বেতন ও জ্বালানি তেল দিয়ে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। এই খরচ তো ট্রলার মালিকরা মাছের উপরেই উঠাবে। তাই দাম বৃদ্ধি। 

তিনি আরও বলেন, ট্রলার মালিকরা যে খুব বেশি লাভবান হচ্ছেন তা কিন্তু না। এখন কিছুদিন ধরে সাগরে ও নদীতে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ছে। কিন্তু প্রায় সময় এমনও হয়, চার লাখ টাকা ব্যয় করে সাগরের মাছ শিকারে গিয়ে মাছ পেয়েছে ৫০ হাজার বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকার। ক্রেতারা কিন্তু এই লোকসানটি দেখছেন না। 

বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, সাগরে সরকারের নানামুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে মাছের পরিমাণ। সাগরে মাছের পরিমাণ আরো বাড়াতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। 

দাম বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মৎস্যজীবীদের সিন্ডিকেটের বিষয়ে কোন অভিযোগ পাননি তিনি। তবে জ্বালানি তেলের কিছুটা প্রভাব মাছের বাজারে পড়েছে। মাছ বাজার আলাদাভাবে মনিটরিং করছে মৎস্য কর্মকর্তারা।