শুক্রবার (০৮ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ৯টা ৮মিনিট। ঢাকার উদ্দেশে ছুটে চলেছে ট্রেন। হঠাৎ চলন্ত ট্রেনের জানালার কাঁচ ভেঙে পাথরের খোয়া আঘাত হানে এক তরুণের মাথায়। কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। ট্রেনে থাকা সেই চিকিৎসক তার চিকিৎসা দিলেন। সহযোগিতা করলেন ট্রেনের টিটিইসহ পুলিশ সদস্যরা।
সেই চিকিৎসক আর কেউ নন। সস্প্রতি ট্রেনের মধ্যে অসুস্থ অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূর মৃত সন্তান প্রসবে চিকিৎসা দেওয়া ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালের চিকিৎসক মো. সানাউল্লাহ। যে ঘটনা ভাইরাল হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
আহত ওই তরুণের নাম রাকিব হাসান (২২)। তার বাড়ি নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার ৫নং খাতা মধুপুর ইউনিয়নের মুশরুদ ধুলিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মো. আবুল কালাম। তিনি ঢাকায় একটি কোস্পানিতে চাকরি করেন।
পড়ুন: মানবতার দৃষ্টান্ত গড়লেন ট্রেনের চিকিৎসক-যাত্রীরা
ডা. সানাউল্লাহ বলেন, ‘গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটানো শেষে শুক্রবার রাতে আন্তঃনগর নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনে স্বপরিবারে সৈয়দপুর থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম। ট্রেনটি সৈয়দপুর স্টেশন ছাড়ার ঠিক ৪ মিনিট পর ৯টা ৮ মিনিটে যাত্রী রাকিব হাসান চিৎকার দেয়। পেছন ফিরে দেখি তার কপাল ও হাত রক্তে ভিজে গেছে। কাছে গিয়ে হাতের টিস্যু পেপার দিয়ে কপালটা চেপে ধরি। জানতে পারি বাইরে থেকে ছোঁড়া পাথরের খোয়ার আঘাতে তার কপালের মাঝখানে কেটে গেছে।’
সানাউল্লাহ আরও বলেন, ‘আশপাশে ট্রেনের গার্ডকে না পেয়ে কল দিলাম টিটিই আমিরুল হক জাহেদী ভাইকে। তাকে বিস্তারিত জানালাম। এর মধ্যে ক্যাটারিংয়ের একজনকে পেয়ে গেলাম, তিনি অন্য বগিতে দায়িত্বরত রেলওয়ে পুলিশকে জানালেন। ৫ মিনিটের মধ্যে মনিরুজ্জামান ও লিটন নামে দুই পুলিশ সদস্য আসলেন। তাদের বললাম দ্রুত ফাস্ট এইড বক্সের ব্যবস্থা করেন।’
কোনো ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত টিস্যু দিয়ে আহত রাকিবের মাথা চেপে ধরে থাকলেন ডা. সানাউল্লাহ যেন রক্তক্ষরণ না হয়। ৯টা ২৫ মিনিটে ট্রেন পার্বতীপুর স্টেশনে পৌঁছার পর ৯টা ৩৬ মিনিটে গজ, তুলা, ভায়োডিন, পেইন কিলার, পিপিআই, ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ হাতে পান তিনি। সবকিছু হাতে পেয়ে ক্ষতস্থান ভালো করে পরিষ্কার করে চাপ দিয়ে আহত রাকিবের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে দেন চিকিৎসক সানাউল্লাহ। এরপর পেইন কিলার খাইয়ে ও কিছু ঔষধ লিখে দেন তিনি।
পড়ুন: সুস্থ আছেন ট্রেনে মৃত সন্তান প্রসব করা মৌসুমী
ক্ষত খুব বেশি মারাত্মক না হওয়ায় চিকিৎসক রাকিবকে জানান ভ্রমণ করতে সমস্যা হবে না। তবে ঢাকায় ফিরে নিকটস্থ হাসপাতালে গিয়ে ড্রেসিং করে নিতে হবে। এভাবেই চলন্ত ট্রেনের মধ্যে চিকিৎসক, ট্রেনের কর্মচারী আর পুলিশের সহযোগিতায় বড় ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যান আহত তরুণ রাকিব।
ডা. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আমি ট্রেন ভ্রমণ উপভোগ করি। কিন্তু এবার ট্রেনে বাড়ি আসা ও যাওয়া দুটোই কষ্টদায়ক ভ্রমণের সাক্ষী হয়ে থাকলাম। ঢাকা থেকে বাড়ি যাবার সময় এক অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূর চিকিৎসা, আর বাড়ি থেকে ফেরার সময় এক আহত তরুণের চিকিৎসা দিতে পারছি, এটা ভেবে ভালো লাগছে। কিন্তু চাই না কেউ এভাবে অসুস্থ হোক, কষ্ট পাক। বাংলাদেশ রেলওয়ের ভাষায় বলতে চাই, আপনার যাত্রা শুভ ও নিরাপদ হোক।’
আহত তরুণ রাকিব হাসান বলেন, ‘গত মঙ্গলবার (০৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে যাই। সেখান থেকে ছুটি শেষে শুক্রবার রাতে ঢাকায় ফিরছিলাম। ট্রেনে ওঠার কিছুক্ষণ পর চলন্ত ট্রেনের জানালা লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়ে দুর্বৃত্তরা। আমার কপালের মাঝখানে সজোরে আঘাত লেগে কেটে যায়।’
ঢাকা থেকে নীলফামারীগামী আন্তঃনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনে গত রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) রাতে চলন্ত ট্রেনের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূর মৃত বাচ্চা প্রসব করান ট্রেনে থাকা চিকিৎসক ডা. সানাউল্লাহ ও নার্সরা। ট্রেনের কামরা হয়ে উঠেছিল অস্ত্রোপচার কক্ষ। সবার সহযোগিতায় বেঁচে যান ওই গৃহবধূ মৌসুমী আক্তার।