সারা বাংলা

শয্যার চেয়ে ৫ গুণ বেশি রোগী লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে

লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শয্যার সংখ্যা মাত্র ১২টি। কিন্তু বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) দুপুর পর্যন্ত এই ওয়ার্ডে শিশু রোগী ভর্তি ছিল ৮০ জন। একেকটি বেডে তিন থেকে চারজন শিশু রোগীকে রাখা হয়েছে। আবার অনেক শিশুকে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এসব শিশুদের সঙ্গে স্বজন রয়েছেন এক বা দুইজন করে। ফলে রোগী এবং তাদের স্বজনদের চাপে শিশু ওয়ার্ড ‘গিঞ্জি’ পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আছে।

শুধু শিশু ওয়ার্ডই নয় পুরুষ ও মহিলা সার্জারি ওয়ার্ড, গাইনী ওয়ার্ডসহ পুরো হাসপাতাল জুড়ে রোগীতে ভরপুর। হাসপাতালের বারান্দা, ওয়ার্ডের মেঝে, করিডর, বাথরুমের সামনে, চলাচলের পথে এমনকি লাশ ঘরের সামনেও বিছানা পেতে রোগীদের চিকিৎসা দিতে দেখা গেছে চিকিৎসকদের। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসা হাজারের বেশি রোগীর ভিড়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপকক্ষকে। আর রোগীরাও অসন্তুষ্ট সেবা নিয়ে।

বুধবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শিশু ওয়ার্ডের প্রতিটি শয্যাতে তিন থেকে চার জন করে শিশু রোগী ভর্তি হয়ে আছে। ওইসব শয্যাতে চার থেকে পাঁচজন করে স্বজন তাদের সন্তানদের কোলে নিয়ে কোনোমতে বসে আছেন। আর ওই ওয়ার্ডের সেবিকারা হিমশিম খাচ্ছে সেবা দিতে গিয়ে।

মিতু আক্তার নামে শিশু রোগীর স্বজন বলেন, আমাদের রোগীকে যে শয্যা দেওয়া হয়েছে, একই শয্যায় আরও তিনজন শিশু ভর্তি আছে। এ তিন শিশুর সঙ্গে আমরা চারজন স্বজন আছি। শয্যাতে ভালোভাবে বসার কোনো সুযোগ নেই। কোনোভাবে আমরা বসে আছি। 

হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার বিষয়ে তিনি বলেন, সকালে চিকিৎসক রোগীদের দেখে যান। পুরোটা দিন নার্সদের (সেবিকা) ওপর ভরসা করে থাকতে হয়। কিন্তু এখানে নার্সও সংকট।

শিশু ওয়ার্ডটিতে শিশুদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত নার্সরা জানান, রোগীর চাপে তাদের দম মেলানোর ফুরসত নেই। রোগীদের স্বজনরাও তাদের ডাকাডাকি করছেন।সেবা দিতে দেরি হলে কোনো রোগীর স্বজন বিরক্তি প্রকাশ করেন, আবার কেউ ক্ষোভও প্রকাশ করেন।

দায়িত্বরত সিনিয়র স্টাফ নার্স পূরবী রানী বলেন, ১২ রোগীর বিপরীতে ৮০ জন রোগী ভর্তি আছে। সারাদিনে আরও রোগী ভর্তি হবে। কাকে রেখে কাকে চিকিৎসা দেব? প্রত্যেক রোগীর স্বজনরা চাচ্ছে তাদের রোগীকে আগে চিকিৎসা দিতে। কিন্তু সব রোগীকেই আমাদের সেবা দিতে হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে, তারপরেও আমরা চেষ্টা করছি।

শিশু ওয়ার্ডের পাশেই গাইনী ওয়ার্ড। সদ্য প্রসূতি নারীরাও এ ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালে গাইনী চিকিৎসক থাকলেও নেই গাইনী কনসালটেন্ট। ফলে কিছুটা ব্যহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। 

সরেজমিনে দেখা গেছে, ১২টি গাইনী শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি রয়েছে ৩৪ জন। এদেরকে চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দায়িত্বরত চিকিৎসক ও নার্সদের। 

গাইনী ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী শাহীনুর বেগম শানী বলেন, বেড না থাকায় মেঝেতে বসে চিকিৎসা নিচ্ছি।

নির্মাণাধীন আড়াইশ শয্যার হাসপাতাল

গাইনী চিকিৎসক জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ওয়ার্ডে ধারণ ক্ষমতার চেয়েও রোগীর সংখ্যা বেশি। আবার প্রতিদিন আউটডোরের রোগী দেখতে হয়। সব মিলিয়ে আমাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে রোগীদের প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া যায়।

ভয়াবহ অবস্থা দেখা গেছে হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার সার্জারি ওয়ার্ডেও। বিভিন্ন রোগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সাথে ডেঙ্গু রোগীরাও একই সঙ্গে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ওই ওয়ার্ডের আনাচকানাচে রোগীদের শয্যা বিছানো হয়েছে। চলাচলের পথে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে রোগীদের।

পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিতে আসা আবুল খায়ের, হাশেম, শেফালি ও রোগীর স্বজন মরিয়মের সঙ্গে কথা হলে তারা হাসপাতালের সেবায় কিছুটা ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তাদের অভিযোগ রোগীরা সময় মতো সেবিকাদের দেখা পান না। বেড নেই, তাই মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে তাদের।

লাশঘরের সামনের মেঝেতে থাকা তোফায়েল আহমেদ নামে অপর রোগীর স্বজন কোহিনুর বলেন, এখানে ফ্যান নেই। গিঞ্জি পরিবেশ তার সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত গরম। রোগীর গরম সহ্য হচ্ছে না। তাই সার্বক্ষণিক হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে হচ্ছে রোগীকে। আমরা খুব কষ্টে আছি।

দ্বিতীয় তলার সার্জারি ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুমা আক্তার বলেন, পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডে শয্যা ৩০টি। রোগী ভর্তি আছেন ১৪৫ জন। নিয়মের চেয়েও কয়েকগুণ রোগী আছে এ ওয়ার্ডে। আমরা যথাসাধ্য সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। বেশি রোগী, তাই হিমশিম খেতে হচ্ছে। হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার তুলনায় ৫ গুণ রোগী আছে।

লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালটি ১০০ শয্যার হাসপাতাল। এর আগে এটি ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল ছিল। তবে ২০০৭ সালে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যাতে হাসপাতালটিকে উন্নীত করা হলেও বাড়েনি চিকিৎসক এবং জনবলের পরিমাণ। প্রায় ১৮ বছরেও জনবল অনুমোদন পায়নি। সেই ৫০ শয্যার চিকিৎসক ও জনবল দিয়েই চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। নামে ১০০ শয্যার হলেও রোগী সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ৫০০’র ওপরে। বুধবার দুপুর পর্যন্ত ১০০ শয্যার হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তি ছিল ৪৩৬ জন।

জনবল সংকট চরমে: ৫০ শয্যার বিপরীতে হাসপাতালে জনবলের সংখ্যা ১৪৮ জন হলেও এখন আছে ১০৫ জন। হাসপাতালটিতে অনুমোদিত চিকিৎসকের পদ ২১টি, কর্মরত আছেন ১৭ জন। চর্ম, গাইনী কনসালটেন্ট, নাক কান গলা রোগের চিকিৎসক নেই এখানে। ৬৫ জন নার্সের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ২৫ জন। আর বিভিন্ন পদে ৩২টি জনবলের বিপরীতে ২২ জন রয়েছেন। 

আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ক্ষোভ: হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের পাশাপাশি প্রতিদিন আউটডোরে হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। তবে রোগীর চাপের তুলনায় চিকিৎসক এবং জনবল কম থাকায় সেবা ব্যহত হচ্ছে। হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীরাও ক্ষুব্ধ সেবা নিয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও কাঙ্খিত সেবা না পেয়ে হতাশ সেবা প্রার্থীরা।

আউটডোরে সেবা নিতে আসা মাকসুদ, কামাল, নুরজাহান বলেন, হাসপাতালে প্রথমে এসে টিকিট কাটতে হয়। টিকিট কাটতে হলে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাইনে দাঁড়াতে হয়। এরপর চিকিৎসকের রুমের সামনে অপেক্ষায় থাকতে হয় কয়েক ঘণ্টা। অন্য চিকিৎসকের কাছে রেফার্ড করলে সেখানেও গিয়েও লাইন ধরে অপেক্ষায় থাকতে হয়। আবার রোগ নির্নয়ে টেষ্ট করাতে হলে সেখানে টাকা জমা দেওয়ার লাইনেও থাকতে হয় কয়েক ঘণ্টা। টেস্ট স্যাম্পলও দিতে হয় দীর্ঘ সময় লাইনে অপেক্ষায় থেকে।

তারা বলেন, এখানে জনবল কম। সে কারণে শত শত রোগীকে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। চিকিৎসক এবং জনবল বাড়ানো হলে রোগীদের ভোগান্তি কমে আসবে।

আবুল খায়ের নামে একজন বলেন, আমি আমার দুই সন্তান রাফি (৬) ও রাজুকে(৫) নিয়ে হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসি। দুই সন্তানের জ্বর। তাদেরকে নিয়ে দীর্ঘ সময় তিনটি লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। হাসপাতালের এমন শোচনীয় পরিবেশে আমার সন্তানেরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেবা প্রদানের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করাসহ হাসপাতালের পরিবেশ উন্নয়নের দাবি তার।

জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার আনোয়ার হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেন, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি। শয্যার চেয়েও পাঁচগুণ রোগী ভর্তি আছেন। মেঝেতে বিছনা বিছিয়ে তাদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। ভর্তিকৃত রোগীর পাশাপাশি আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার থেকে ১২০০ রোগী সেবা নিতে আসেন। আমাদের চিকিৎসক এবং জনবল হলো ৫০ শয্যার। তাও নির্দিষ্ট পদের থেকে কম জনবল আছে। এদেরকে দিয়েই এতো পরিমাণ রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরও আপ্রাণ চেষ্টা করছি, সেবা দিতে। আড়াইশ শয্যার হাসপাতালের কাজ শুরু হলে তখন ওই পরিমাণ শয্যার বিপরীতে জনবল দেওয়া হবে।

নির্মাণাধীন আড়াইশ শয্যা হাসপাতালের কাজ শেষ হয়নি ৫ বছরেও: ২০১৭ সালে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালকে আড়াইশো শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর শুরু হয় হাসপাতালটির নির্মাণ কাজ। গণপূর্তের মাধ্যমে ২০১৮ সালের দিকে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে রুপালী জিএম এন্ড সন্স কনস্ট্রাকশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কাজ শেষ হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে লক্ষ্মীপুর গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী লাবণ্য বড়ুয়াকে ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। 

সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার আনোয়ার হোসেন জানান, ২০২৪ সালের জুন মাসের দিকে হাসপাতালের ভবনটি তাদেরকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা রয়েছে।