সারা বাংলা

১০ বছর বয়স থেকেই গান করছেন, শেষ বয়সে দিন কাটছে অসুস্থতায়

‘বাউলের বাতাসে যারে পাইছে-পাগল হইছে, লাম্বা চুল মাথায় লুইয়া ঘুরছে। বাউলের আউলা মতি ঘুরিতেছে দিবারাতি, সঙ্গের সাথী একতারা বানাইছে’। এ গান বাউল শিল্পী তছকির আলীর।

৭০ বছর বয়সী এই বাউলের বসতি সুনামগঞ্জ পৌর শহরের হাসনগর এলাকার যাউয়ার হাওরের পাড়ে। স্ত্রী ও তিন মেয়ে এবং এক ছেলে নিয়ে ৬ সদস্যের পরিবার। 

তছকির আলী বাউল গান করছেন তার ১০ বছর বয়স থেকে। বাউল গানের প্রেমে পড়ে তিনি গানে গানে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবন যৌবন। তবে শেষ বয়সে এসে অসুস্থতার কারণে দিন কাটছে বাড়িতে বসে বসেই। অসহায় এই সময়ে তিনি সরকারের কাছে মাসিক অর্থ সহায়তা চেয়েছেন। 

আলাপকালে বাউল তছকির আলী বলেন, ‘আমি গান গাইছি আর চলছি। বিভিন্ন জেলায় গেছি, তবে আমার যে আয় ব্যয় তার দিকে আমি লক্ষ্য করছি না। আমি টাকা রুজি কইরা দুই কিয়ার জমি কিনতাম বা ৫০ হাজার টাকা ব্যাংকে থাইতাম- এই ধরনের কোনো খিয়াল আমার ছিলো না। এখনও এইগুলা আমার ভিতরে আইছে না। এখন শরীর দুর্বল হই গেছে। আমার যখন ৯-১০ বছর তখন থেকে আমি গানে জড়িত হয়ে গেলাম। আমার যে গানের প্রতি এতো প্রেম আগ্রহ আছিল তা সীমাহীন, আমার গ্রামবাসী সবাই জানতেন। গানের প্রতি এতো প্রেম দেখে বাবা আমাকে ছাতকের বাউল ফকির দুর্বিন শাহ'র কাছে দিয়েদিলেন। দিয়ে বললেন, আজকে থেকে সে আপনার সন্তান। এরপর থেকে আমি এখনও গানের সাথে আছি।’

বাউল তছকির বলেন, ‘আমরা যারা বাউল গান করি, আমরা তো বাউল বলতেই দূর্বল, বাউল বেশিরভাগই গরিব। একশ ভাগের মধ্যে ৮০ ভাগই গরিব, ২০ ভাগ একটু ভালো আছে। অনেকে আছে গানের উপর নির্ভর, আমরার কোনো সংসার নাই, জমিজমাও নাই। আমরার গানের উপরেই সংসার, আমরারে উপর ওয়ালা চালাইন। কিন্তু এখন আমরা যারা দূর্বল আছি, একটু অসহায় আছি আমরার প্রতি যদি কিছু সবল মানুষ দৃষ্টি রাখেন তাহলে আমরা কিছুটা আরাম পাইমু, আনন্দ পাইমু।’  

তিনি আরও বলেন, ‘যদি সরকার পারেন, আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য কোনো একটা (বড় ভাতা) প্রতি মাসে মাসে যারা অসচ্ছল শিল্পীরা আছেন, তাহলে আমরার একটু উপকার হতো।’   কেবল তছকির আলী একাই নন, তার মতো অসংখ্য বাউল শিল্পী আছেন হাওরাঞ্চলে। যারা তেমন নামীদামী শিল্পী না, কিন্তু তারা গান করে জীবন বাঁচান। অভাব-অনটনে কাটে তাদের দিন। তবে আর্থিকভাবে অসচ্ছল বাউলদের কদর জানিয়ে রেজুলেশনের মাধ্যমে ১০ জন বাউলকে প্রতি মাসে ভাতা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সুনামগঞ্জ পৌরসভা। যা চলতি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ১০ জন বাউলের হাতে তুলে দিয়ে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত। 

সুনামগঞ্জ পৌরসভার সম্মানী ভাতা পাওয়া ১০ বাউল শিল্পী হলেন, তছকির আলী, রশিদ উদ্দীন, পল্লী কবি জবান আলী ফকির, মিরাজ আলী, কানু দাস, জাকির হোসেন, আওয়াল মিয়া, সৈয়দুর রহমান ও শফিক উদ্দিন। 

পৌরসভার সম্মানী ভাতা পেয়ে আনন্দিত পল্লী কবি জবান আলী ফকির। তিনি বলেন, ‘মেয়র সাহেব আমাদের ডেকে এনে পৌরসভার ভাতা আজীবন পাওয়ার জন্য ৫০০ টাকা করে দিয়েছেন। ৫০০ টাকা নয় এটা আমরা মনে করি ৫ লক্ষ টাকা পেয়েছি। প্রতি মাসে আমাদেরকে উনি (মেয়র নাদের বখত) দিয়ে দিতেছেন। কোনো দেশে এই প্রথা নাই বা কোনো দেশে এই রকম করেও নাই। আমি আরও ছয় জন্যের জন্য মঞ্জুর করিয়েছি। তারাও কাল বা পরে দরখাস্ত দিয়ে এই টাকা নিয়ে যাইবো। আমি পৌরসভার মেয়র ও কর্মকর্তা যারা আছেন সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।‘ 

পৌর মেয়র নাদের বখত বলেন, ‘আমরা সুনামগঞ্জ পৌরসভার পক্ষ থেকে এমন কিছু করতে চাই যেটা অতীতে হয়নি। আমরা অবকাঠামোগত উন্নয়নে হয়তো পিছিয়ে। অনেকের ধারণা মতে, রাস্তা-ঘাটের মধ্যে অনেক খানাখন্দ আছে যেগুলোতে আমাদের রেগুলার কাজ করতে হয়। আমরা চাচ্ছি ব্যতিক্রম ধর্মী কিছু উদ্যোগের মাধ্যেমে জনগণের উপকারে আসা। যেটাকে জনগণ মনে রাখবে সারাজীবন। ঠিক তার ধারাবাহিকতায় আমরা আমাদের সুনামগঞ্জ আউল বাউলের দেশ, যেখানে রাধারমণ দত্ত, দুর্বিন শাহ, হাসন রাজা, শাহ্‌ আব্দুল করিমসহ অসংখ্য শিল্পী এবং কবির জন্ম। এসব শিল্পীর বিপুল অংশ পাওয়া যায় এই সুনামগঞ্জে। এর মধ্যে আমরা সুনামগঞ্জের ১০ জন বাউল শিল্পীকে, যারা গান লিখেছেন, যারা গান করেছেন, উনারা অনেকেই এখন বয়স্ক। যথেষ্ট বয়স হয়েছে উনাদের। উনাদেরকে সামান্য একটু সম্মাননা দেওয়ার চেষ্টা করছি, সেটা প্রতি মাসে দেবো আমরা। যেহেতু রেজুলেশন আকারে নিয়েছি- আমি যতোদিন আছি পৌরসভার মেয়র হিসেবে, ঠিক ততোদিন তো ইনশাল্লাহ উনারা পাবেন।‘