সুনামগঞ্জের তিনটি বর্ডারে হাট ও আশপাশের এলাকা এখন ভারতীয় চিনি-পেঁয়াজের বন্দর হিসেবে স্থানীয়দের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে।
সীমান্তের ওপার থেকে প্রতি বর্ডার হাটবারে গভীর রাত পর্যন্ত কোটি কোটি টাকার ভারতীয় চিনি, পেঁয়াজ, শাড়ি-কাপড়, কসমেটিক্স, ফলমূল ও চকলেটসহ বিভিন্ন পণ্য কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে এপারে আসছে।
সীমান্তরক্ষী বিজিবি, থানা পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে সড়কপথে ট্রাক, পিকআপ ও নৌকাযোগে পরিবহন হচ্ছে হরহামেশা এসব অবৈধ মালামাল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নজরদারী না থাকায় চোরাকারবারিরা নির্বিঘ্নে তাদের এ অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অবৈধ পথে এ ব্যবসার ফলে রাতারাতি চোরাকারবারিরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছেন। লাভজনক এমন ব্যবসায় উৎসাহিত হয়ে চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে।
সুনামগঞ্জ সীমান্তের তিনটি বর্ডার হাটের প্রথমটি হলো, ডলুরা-বালাট সীমান্ত হাট। যা ২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জাহাঙ্গীর ইউনিয়নের ডলুরা এলাকায় এবং ভারতের মেঘালয়ের বালাট সীমান্ত এলাকায় চালু হয়। এই হাট বসে সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার। এখানকার ৫০টি দোকানকে দুই দেশের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া আছে।
এই সীমান্তের দ্বিতীয় বর্ডার হচ্ছে দোয়ারাবাজার উপজেলার ভোগলা ইউনিয়নের বাগানবাড়ি বর্ডার হাট। ভারতের মেঘালয়ের রিংকু ও বাগানবাড়িতে এই হাটের অবস্থান। এই হাট বসে প্রতি বৃহস্পতিবার। এই হাটের ৫০টি দোকান দুই দেশের দোকানীদের ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
সীমান্তের তৃতীয় এবং দেশের ১৪ তম বর্ডার হাট হচ্ছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তের লাউড়েরগড় ও ভারতের পশ্চিম হিল সীমান্তের সায়েদাবাদ বর্ডার হাট। এই হাট বসে সপ্তাহের প্রতি বুধবার। এখানেও একইভাবে দোকান ভাগ করে দেওয়া আছে। প্রতি হাটে বাংলাদেশের ক্রেতা কার্ড আছে পাঁচশ’ থেকে সাড়ে পাঁচশ’র মতো। সকাল ১০টায় শুরু হয়ে বিকাল ৪টায় বর্ডার হাটের কেনাকাটা শেষ হবার কথা থাকলেও গেল প্রায় ছয় মাস যাবৎ গভীর রাত পর্যন্ত এসব হাট দিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকার ভারতীয় চিনি, পেঁয়াজ, ফলমূল, চকলেট, কসমেটিক্সসহ বিভিন্ন পণ্য ঢুকছে দেশের অভ্যন্তরে।
গত কয়েক মাসে সুনামগঞ্জের সীমান্ত এলাকা জুড়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসা ভারতীয় চিনি ও পেঁয়াজ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে দিচ্ছে এখানকার চোরাচালানীরা। চোরাচালানীদের সহযোগিতা করছে স্থানীয় কিছু অসৎ জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বিশ্বম্ভরপুর-সুনামগঞ্জ সড়ককে নিরাপদ সড়ক হিসেবে ব্যবহার করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে এসব চোরাই পণ্য। এছাড়া রক্তি নদী হয়ে জেলার নদীবন্দর খ্যাত সাচনা বাজারেও যাচ্ছে প্রতিদিন শত শত বস্তা পেঁয়াজ ও চিনি।
দোয়ারাবাজারের বাগানবাড়ি রিংকু বর্ডার হাটের গত দুই বৃহস্পতিবারে সরেজমিনে দেখা গেছে, সীমান্তের ওপার থেকে শত শত কাভার্ড ভ্যানে কোটি কোটি টাকার মালামাল এসেছে এবং এপারের বাজার থেকে ভ্যান, অটো রিক্সাসহ নানা যানবাহনে এই মালামাল সীমান্ত হাট থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চলে। একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে, লাউড়েরগড় বর্ডার হাটেও।
বিশ্বম্ভরপুরের একজন গণমাধ্যম কর্মী জানান, উপজেলার সীমান্ত রাজাপুর, মাছিমপুর ও ডলুরা দিয়ে কোটি কোটি টাকার চিনি, পেঁয়াজ প্রতিদিন এপারে আসছে। তাহিরপুরের লাউড়েরগড় ও দিঘারতলা; দোয়ারাবাজারের কলাউড়া, বাঁশতলা, মুকামচড়া; লক্ষীপুর ইউনিয়নের ভাঙাপাড়া, মাঠগাঁও; বোগলাবাজার ইউনিয়নের পেকপাড়া, ইদিকুনা ও কইয়াজুরি এলাকাকে নিরাপদ জোন হিসেবে ব্যবহার করছে চোরাকারবারীরা।
সাচনা বাজারের একজন ব্যবসায়ী জানালেন, প্রতি রাতে রক্তি নদী হয়ে নৌকায় এবং আব্দুজ জহুর সেতু এলাকা থেকে গাড়িতে কমপক্ষে ৫০০-৭০০ বস্তা চিনি, ৫০-১০০ বস্তা পেঁয়াজ আসে কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে। তারা এগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রয় করেন। নৌ-পথেই এসব মালামাল পৌঁছানো হয় বেশি।
লাউড়েরগড় বর্ডার হাটের লাউড়েরগড় এলাকার সাইদুল ইসলাম বলেন, এ হাট চালুর পর এলাকায় চোরাচালান বেড়েছে। দুই দেশের চোরাকারবারিরা হাটে প্রবেশ করে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অর্ডার করছেন। পরে তা চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করছে।
স্থানীয় একজন ইউপি সদস্য নিজের নাম পরিচয় উদ্ধৃত না করার অনুরোধ করে বলেন, সরেজমিনে ছদ্মবেশে বর্ডার হাটে এসে দেখে যান; প্রতি রাতে কত কোটি টাকার মালামাল নামছে। আশ্চর্য হয়ে যাবেন আপনি।
দোয়ারাবাজারের বাগানবাড়ি-রিংকু বর্ডারহাটের একজন বাংলাদেশি দোকানী বলেন, প্রতি হাটবারে ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ক্যারেট চিনি, পেঁয়াজ, আলু, আপেল, কমলা ও নারিকেল নামছে এপারে। যা এখান থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নৌকা ও ট্রাকে চলে যাচ্ছে। বাজার কমিটির লোকজনকে ক্যারেট প্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা দিলেই নামতে কোনো বাধা নেই। এখানে যারা টাকা তোলার কাজ করে তারা ভোগলাবাজার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজন।
ওখানকার একজন ব্যবসায়ী (কার্ডধারী ক্রেতা) ইসমাইল হোসেন অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, প্রতি কার্ডে ২০-২৫ হাজার টাকার বেশি মালামাল নামানো হয় না। এর বাইরে সামান্য কিছু মালামাল বিজিবি ও বাজার কমিটির লোকজনকে ৫০০-১০০০ টাকা দিয়ে নামানো যায়। তবে বেশি মালামাল নামানো যায় না।
সুনামগঞ্জ ২৮ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্ণেল মাহবুবুর রহমান বলেন, একটি জেলার সীমান্তে তিনটি বর্ডার হাট দেশের অন্য জেলায় আছে বলে আমার জানা নেই। এখানকার মানুষের জীবনযাপনের মানোন্নয়নের জন্যই এটি করা হয়েছে। কিন্তু কিছু মানুষ এর অপব্যবহার করার চেষ্টা করছে। বর্ডার হাটগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় আমিও উত্থাপন করেছি। এখানে বিজিবি কেবল নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার কথা। কে কত টাকার মালামাল নিচ্ছে, সেটি দেখার এখতিয়ার বিজিবি’র নেই।
পেঁয়াজ, চিনি নিয়ম বহির্ভূতভাবে নামার বিষয়টি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমিও আইন-শৃঙ্খলা সভায় বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে রাখার তাগিদ দিয়েছি। বিজিবি’র কোনো সদস্য ওখানে কোনো অপরাধ কর্মে যুক্ত হবার অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বর্ডার হাটগুলোতে চার-পাঁচ ঘণ্টার জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেট থাকা জরুরি।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বর্ডার হাটের কার্যক্রম দেখভাল করেন। আগের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বদলি হওয়ায় নতুন একজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যোগদান করেছেন। তিনি খোঁজখবর নেবেন, সরেজমিনে গিয়ে দেখবেন। এরপর কীভাবে বর্ডার হাটকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখা যায় সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।