সারা বাংলা

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি : বাবার কবরের পাশেই চির নিদ্রায় ছামীম

সাত মাস আগেই প্রবাসে মারা যান বাবা। একটু একটু করে যখন পরিবার আর সন্তানরা সেই শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই আরেকটি ঝড় এসে তছনছ করে দিলো গোটা পরিবারটিকে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মুহুর্তেই ঝরে গেল পরিবারের সবচেয়ে আদরের ফুল আব্দুল্লাহ ছামীম (১৪)। 

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ডিএমখালি মাঝিকান্দি এলাকার আবুল কালাম মাঝি ও জুলেখা বেগম দম্পত্তির ছেলে আব্দুল্লাহ ছামীম। থাকতেন ঢাকার উত্তরা দিয়াবাড়ি খালপাড় এলাকায়। ভাই-বোনদের মধ্যে সবার ছোট ছামীম। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ মেধাবী। স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। আগে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করলেও পরবর্তীতে তাকে উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। 

২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রবাসে মারা যান বাবা আবুল কালাম মাঝি। এরপর থেকে মা, বোন ও বড় ভাইয়ের আদর যত্নে বেড়ে উঠছিল সে। প্রতিদিনের মতো সহপাঠীদের সাথে সোমবার (২১ জুলাই) বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করছিল ছামীম। টিফিনের আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি, এরইমধ্যে বিকট শব্দে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয় বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান। 

সেই ঘটনায় অন্যান্যদের সাথে গুরুতর আহত হয় ছামীম। পরবর্তীতে তাকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার করে স্বজনদের খবর দেয়। অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। অবস্থা গুরুতর হওয়ার তাকে ভর্তি করা হয় বার্ন ইউনিটে। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতে ১১টার দিকে মৃত্যু হয় তার।

এদিকে ছামীমের মৃত্যুর খবর তার গ্রামে পৌঁছলে এলাকাজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সকালে তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি ডিএমখালি মাঝিকান্দি এলাকায় পৌঁছায়। পরে সকাল ৯টায় চরভয়রা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশেই সমাহিত করা হয় তাকে। 

ছামীমের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা। আর ছেলের মৃত্যুতে কিছুক্ষণ পর পর মূর্ছা যাচ্ছেন মা জুলেখা বেগমও। 

আহাজারি করতে করতে জুলেখা বেগম বলেন, “আমার বাবাটা বলেছিলো, হাসপাতাল এতো দূরে কেন? কাছাকাছি হাসপাতাল হতে পারে না? আমাকে তোমরা চিকিৎসা করাতে বিদেশে নিয়ে যাও। আমার বাবা বাঁচতে চাইছিল। কেন আমার বাবা এভাবে চলে গেলো?” 

আব্দুল্লাহ ছামীমের মামাতো ভাই বারেক হোসাইন বলেন, “আমাদের খুবই আদরের ছিল ও। নম্র, ভদ্র এবং মেধাবী হওয়ার কারণে আমরা তাকে ভীষণ ভালবাসতাম। আমার ফুফা সাত মাস আগে সৌদি আরবে মারা যান। সেই শোক কাটাতে না কাটাতে আমাদের আদরের ছামীমও চলে গেল। সবাই ছামীমের জন্য দোয়া করবেন, যেন আল্লাহপাক ওকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।”

ছামীমের একইসাথে বেড়ে উঠেছিল তার মামাতো ভাই আব্দুল্লা হুসাইন। গ্রামে গেলে তারা দুজন সময় কাটতো একসাথে। এমনকি ঢাকায় গেলে আব্দুল্লাকেও বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখাত ছামীম। ছোট বেলার খেলার সাথীকে হারিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েছে আব্দুল্লা। 

প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সে বলে, “একসাথে বড় হয়েছি। আমি ঢাকায় কিছুই চিনতাম না ও আমাকে ঢাকা ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। আজ ছামীম আমাকে একা রেখে চলে গেলো, আমি কীভাবে থাকব?”

ভাগ্নেকে ভীষণ ভালবাসতেন মামা সাইফুল ইসলামও। ছোট ভাগ্নের এমন করুন মৃত্যু যেন কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। তিনি বলেন, “ছোটবেলা থেকে ভীষণ মেধাবী ছিল আমার ভাগ্নে। ওর স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে চিকিৎসক হবে। বাবার মৃত্যুর পর ওকে সবাই আগলে রেখেছিলাম। আজ ও আমাদের ছেড়ে বাবার কবরের পাশেই চির নিদ্রায়। ওর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন আজ স্বপ্নই রয়ে গেলো।”

এসময় তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘‘বিমান প্রশিক্ষণের জন্য খোলা ময়দান রয়েছে। কিন্তু ব্যস্ততম এলাকায় যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল, সেই জায়গায় কীভাবে বিমান প্রশিক্ষণের জন্য দেওয়া হলো? আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই।”

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী আবরার বলেন, “আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, নিহতের সঠিক সংখ্যা লুকানো হচ্ছে। আমরা চাই নিহতদের সঠিক সংখ্যা প্রকাশ্যে আসুক। এছাড়া তদন্তের মাধ্যমে দুর্ঘটনার কারণ বের হয়ে আসুক। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের কোনো ঘটনা না ঘটে সেজন্য সরকার কঠিন পদক্ষেপ নিবে এটাই আশা করি। আর কোনোদিন যেন এভাবে কোন মায়ের বুক খালি না হয়।”

এ ব্যাপারে ভেদরগঞ্জ সহকারী কমিশনার ভূমি ও ভারপ্রাপ্ত ইউএনও মোহাম্মদ মোজাহেরুল হক বলেন, “মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা। আজ রাষ্ট্রীয় শোক পালন করছি। আমরা নিহতের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে আমরা সব সময় থাকব।”