সারা বাংলা

দুই মাসে পদ্মার পেটে ২০০ হেক্টর জমি

পদ্মা নদীর ভাঙন যেন দমে না গিয়ে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা গিলে খাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে।  ভাঙনের ভয়াবহতায় মানুষজন দিনের মতো রাতেও আতঙ্কে সময় পার করছেন। যেখানেই পানির চাপ বাড়ছে, সেখানেই ফসলি জমি, ঘরবাড়ি ও বাজার মুহূর্তেই নদীর পেটে চলে যাচ্ছে।

আজিমনগর, সুতালড়ী ও লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নগুলোতে ভাঙনের মাত্রা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। চরাঞ্চলসহ কুশিয়ারচর ও মালুচি এলাকার কলা বাগান, বসতবাড়ি এবং আবাদি জমি একের পর এক বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

উপজেলার কৃষি অফিসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, গত দুই মাসেই প্রায় ২০০ হেক্টর আবাদি ও অনাবাদি জমি, সঙ্গে অন্তত ১৫০টি বসতভিটা পদ্মার গর্ভে হারিয়ে গেছে। ভাঙন আতঙ্কে শত শত পরিবার তাদের বাড়ি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়েছেন।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের হরিহরদিয়া, গঙ্গাধরদি, পাটগ্রাম ও সেলিমপুর এলাকা। সেখানে ভাঙনের গতি এতটাই ভয়াবহ যে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে একাধিক বাড়ি নদীতে তলিয়ে গেছে। সেলিমপুর বাজার পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে। পাশাপাশি হরিহরদিয়া ও গঙ্গাধরদি বাজার ভাঙনের হুমকিতে থাকায় অন্যত্র সরিয়ে নিতে হয়েছে। হরিহরদিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পও রক্ষা পায়নি নদীর থাবা থেকে। 

এই প্রকল্পের প্রায় অর্ধেক ঘর ভাঙনের কবলে পড়েছে। ফলে প্রায় ১০০ পরিবার নতুন করে আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হয়েছে।  মাত্র দুই মাসে প্রায় ৪০০ পরিবার বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।

এলাকাবাসী বলছেন, শুধু জিওব্যাগ ফেলা নয়, টেকসই বাঁধ নির্মাণ ছাড়া ভাঙন ঠেকানো সম্ভব নয়। পদ্মার ভাঙন এখন কেবল একটি মৌসুমি দুর্যোগ নয়; বরং মানুষের জীবন ও জীবিকার স্থায়ী সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবার ভাঙন নতুন করে হাজারো মানুষকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে।

হরিহরদিয়া গ্রামের রাসেল মিয়া বলেন, “জোয়ার শুরু হতেই ভাঙন শুরু হয়। দিন-রাত সমান তালে ঘরবাড়ি ও জমি নদীতে চলে যায়। আমরা অনেকেই আগেভাগেই ঘর সরিয়ে নিয়েছি। তবুও নিরাপত্তা নেই। পানি যদি আবার বাড়তে থাকে, ভাঙনও বেড়ে যাবে। একসময় হয়তো এই চরাঞ্চল পুরোপুরি নদীতে হারিয়ে যাবে।”

কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের কুশিয়ারচরের কৃষক আবদুল হাকিম বলেন, “আমাদের কলার বাগান নদীতে তলিয়ে গেছে। চোখের সামনে বছরের পরিশ্রম পানিতে ভেসে গেল। এখন আর কিছু করার নেই।”

গৃহবধূ শিরিনা বেগম বলেন, “ভাঙনের ভয় এতটাই যে রাতে ঘুমাতে পারি না। প্রতিদিনই মনে হয়, আজ হয়তো ঘরটাও নদীতে চলে যাবে। অনেকেই নিরাপদ জায়গায় চলে গেছেন। আমরা এখনো টিকে আছি, কিন্তু কতদিন টিকতে পারব তা বলা কঠিন।”

স্থানীয় কৃষক ইউনুস মোল্লা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা বারবার দাবি করেছি—এলাকা রক্ষায় স্থায়ী বাঁধ দেওয়া হোক। কিন্তু বর্ষা এলেই সাময়িক কিছু কাজ করা হয়, পরে আর কোনো উদ্যোগ থাকে না। এভাবে চলতে থাকলে, কয়েক বছরের মধ্যেই পুরো চরাঞ্চল নদীতে হারিয়ে যাবে।”

মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেন, “হরিরামপুর উপজেলার পদ্মা নদীর বাম তীরে লেছড়াগঞ্জ, সুতালড়ি ও আজিমনগর ইউনিয়নের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার মানুষের বসবাস। নদীভাঙনে তাদের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে। আমরা কারিগরি সমীক্ষা করার উদ্যোগ নেব। সমীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে টেকসই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরি ভিত্তিতে লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের কুশিয়ারচর এলাকায় ১২০ মিটার জিওব্যাগ ফেলা শুরু করেছে।”