কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসাবে পরিচিত গোপালগঞ্জ জেলায় রয়েছে তিনটি সংসদীয় আসন। প্রতিবারের নির্বাচনে এই আসনগুলো থেকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয় পেতেন দলটির হেভিওয়েট প্রার্থীরা। অধিকাংশ সময় অন্য দলের প্রার্থীরা হারাতেন তাদের জামানত।
জুলাই আন্দোলনের পর জেলার রাজনীতিতে পরিবর্তন এসেছে। ভোটের ফলাফল ভিন্ন হতে পারে। বিশেষ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগের ভোট কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন অনেকে।
গ্রেপ্তার আতঙ্কে নেতাকর্মীরা এলাকা ছাড়া হওয়ায় আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো রাজনৈতিক সক্রিয়তা নেই। যদিও অভিজ্ঞ মহলের মতে, বাস্তবতা ও ভোটের হিসাব অন্যরকম। বিএনপি, জামায়াত এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগ ভোটারদের ভোট নিজেদের দিকে আনার চেষ্টা করছেন। কারণ, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা অংশ নেবেন তাদের এই ভোটের ওপর নির্ভর করতে হবে।
ভোটাররা মনে করছেন, যদি কোনো প্রার্থী ব্যক্তিগত পরিচিতি আর গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগাতে পারেন, তাহলে আওয়ামী লীগের যেসব নীরব ভোটার আছেন তাদের ভোট ক্যাশ করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান অন্য দলের থেকে ভালো। আর যদি কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগের ভোট কাজে লাগাতে পারেন তাহলে তিনি জয় পাবেন। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং গণঅধিকার পরিষদের যে কমিটি এই জেলায় হয়েছে, তাদের নেতাদের আমজনতাই শুধু নয়, যারা ভোটের সময় বিশেষ ভূমিকা রাখেন তারাও চেনেন না।
গোপালগঞ্জ-১ আসটি মুকসুদপুর উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এবং কাশিয়ানী উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এ আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত। বিগত ছয়টি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) মো. ফারুক খান বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছেন। সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্রপ্রার্থী মো. কাবির মিয়ার সঙ্গে নির্বাচনে খুব কম ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। সে সময়ে কাবির মিয়ার নিজ ইমেজের ভোট আর সেই সঙ্গে এন্টি আওয়ামী লীগের ভোটে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন।
এবারের নির্বাচনে এ আসনে ইতোমধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। বিএনপি থেকে দলটির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম, জামায়াত থেকে দলটির সাবেক জেলা আমির মাওলানা আব্দুল হামিদ এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট মো. মিজানুর রহমান এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে মুকসুদপুর উপজেলা সমন্বয় কমিটি যুগ্ম সমন্বয়ক ইশতিয়াক আজীকে এ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
মুকসুদপুর উপজেলার কৃষ্ণদিয়া গ্রামের ভোটার সোহরাব হোসেন বলেন, “গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত। এ আসনে বারবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। এবার যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে না পারে, তাহলে আওয়ামী লীগের ভোট টানতে চাইবে অন্যান্য দলের প্রার্থীরা। এতে আওয়ামী লীগের ভোট ভাগ হতে পারে। এনসিপি যাকে প্রার্থী করেছে তাকে আমি চিনি না।”
অপর ভোটার কমলাপুর গ্রামের হাসিবুর রহমান বলেন, “মনে হচ্ছে, এবার আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে পারবে না। ফলে আওয়ামী লীগের ভোট টানতে ও জয়লাভ করতে নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন প্রার্থীরা। যে প্রার্থী আওয়ামী লীগের ভোট টানতে পারবেন তারই জয়লাভ করার সম্ভবনা বেশি। সে ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মাথা ব্যাথার কারণ হতে পারে অন্য দলগুলোর প্রাথীদের জন্য।”
একই গ্রামের ভোটার জাহেদুল ইসলাম বলেন, “এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন দল ভোটের মাঠে রয়েছে। এই আসনটি আওয়ামী লীগের আসন হিসাবে পরিচিত। বিগত নির্বাচনগুলোতে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে। এ আসনে যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকে তাহলে ভোটের হিসাব পুরোটাই পাল্টে যাবে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভোট স্বতন্ত্র প্রার্থীর বাক্সে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রার্থী ইশতিয়াক আজীম বলেন, “গোপালগঞ্জে আমরা মানুষকে সচেতন করতে নানা কর্মসূচি পালন করছি। মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে, নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয় সে বিষয়ে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছি। একটি দল ক্ষমতা নিজেদের কাছে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। আমরা চাই, ক্ষমতার অধিকারী হবে সাধারণ মানুষ। আমরা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীয়করণ করতে চাই। যাতে কেউ ক্ষমতা নিজের মধ্যে ধরে রাখতে না পারেন।”
তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে আমরা বিভিন্ন জায়গায় সভা সমাবেশ করছি। আমি মনে করি, সাধারণ ভোটারা আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন।”
জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা আব্দুল হামিদ বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে এ আসনে কোনো নির্বাচন হয় না। দিনের ভোট রাতে করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে জিতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। এ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী নির্বাচিত হবেন। তাই বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করার পাশাপশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। দাড়িপাল্লা প্রতীকে ভোট চাওয়া হচ্ছে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পাশাপশি দেওয়া হচ্ছে নানা প্রতিশ্রুতি।”
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মিজানুর রহমান বলেন, “আইন পেশার পাশাপাশি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতায় কর্মরত রয়েছি। বর্তমানে দৈনিক নবরাজ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ও পত্রিকার ইনচার্জের দায়িত্বে রয়েছি।। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে মুকসুদপুর ও কাশিয়ানি উপজেলায় গণসংযোগ, সভা-সেমিনারসহ সাধারণ মানুষের কাছে দোয়া ও হাত পাখায় ভোট চাচ্ছি। মুকসুদপুর ও কাশিয়ানিতে চরমোনাই পীরের বিপুলসংখ্যক মুরিদান ও দলীয় সমর্থক রয়েছেন। আমাদের মুকসুদপুর উপজেলা ও কাশিয়ানিতে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার হাতপাখার রিজার্ভ ভোট রয়েছে। আশা করি, ভোটারা আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন।”
বিএনপি প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম বলেন, “আওয়ামী লীগের আমলে হওয়া তিনটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। এ সময় ভোটারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। এবারের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। ভোটারদের আস্থা অর্জন করে নির্বাচন জিতে আসনটি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উপহার দেওয়া হবে। এ কারণে নেতাকর্মীদের ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পৌঁছে দেয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছ।”
গোপালগঞ্জ-১ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৫ হাজার ২৯২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৬ হাজার ৩৬৫ জন ও নারী ভোটার ১ লাখ ৯৮ হাজার ৯২৭ জন। এ আসনে ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৮টি ও কক্ষের সংখ্যা ৮১৫টি।