সারা বাংলা

টিটোর আত্মত্যাগে শত্রুমুক্ত হয় সাভার

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। বিজয়ের ঠিক দুই দিন আগে। ঢাকার সন্নিকটে সাভারের আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় তখন চলছে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি যুদ্ধ। চারদিকে গুলির শব্দ। সেই যুদ্ধে অসীম সাহস নিয়ে লড়াই করে শহীদ হন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম দস্তগীর টিটো। সেদিন তার আত্মত্যাগে শত্রুমুক্ত হয় সাভার।

গোলাম দস্তগীর টিটো ছিলেন একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, মানিকগঞ্জের উত্তর শেওতা গ্রামে। তিনি ছিলেন তৎকালীন ন্যাপ (মোজাফফর) নেতা গোলাম মোস্তফার ছেলে। একাত্তরে টিটো পড়তেন দশম শ্রেণিতে। বয়সে কিশোর হলেও সাহসে ছিলেন দুর্ধর্ষ।

টিটোর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পেছনে ছিল এক নির্মম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল তার ভাইকে রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। পরে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় তাদের পুরো গ্রাম। চোখের সামনে ভাইয়ের নির্মম মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি। সেদিনই যুদ্ধে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নেন তিনি।

প্রশিক্ষণ শেষে টিটোকে প্রথমে পাঠানো হয় ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে, সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের বাহিনীতে। পরে তিনি ঢাকায় আসেন এবং যোগ দেন ঢাকার গেরিলা কমান্ডার নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন গেরিলা দলে, যা ‘মানিক গ্রুপ’ নামে পরিচিত ছিল।

ভারতের অন্তিম নগর থেকে ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ৫২ জন গেরিলা যোদ্ধা আশুলিয়ার গাজীবাড়ী এলাকার নেঁদু খার বাড়িতে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেন। সেখানে দেড় মাস ধরে কয়েক শতাধিক নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নেতৃত্বে আশুলিয়ার তৈয়বপুরে আরেকটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ওই গেরিলা দলের সঙ্গে টিটো ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর সাভার থানার ইয়ারপুর গ্রামে এসে অবস্থান নেন।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে সারাদেশে কোণঠাসা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে রাজধানী ঢাকার দিকে পিছু হটছিল তারা। টাঙ্গাইল থেকে বিতাড়িত হয়ে ১৪ ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর ৪০-৫০ জনের একটি দল ঢাকার পথে আশুলিয়ার জিরাবো এলাকার ঘোষবাগ-গঙ্গাবাগ গ্রামে পৌঁছায়। সেখানেই তাদের পথরোধ করে দাঁড়ায় শহীদ টিটোর গেরিলা দল।

হাতের কাছে চলে আসা শত্রু বাহিনীর শেষ দলটিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রত্যয়ে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নেতৃত্বে ‘মানিক গ্রুপ’ মুখোমুখি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। টাঙ্গাইলে প্রচণ্ড মার খাওয়া মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানি সেনারা তখন প্রাণভয়ে দিশেহারা। সাভারের মাটিতে তাদের কয়েকজন সেদিনকার যুদ্ধে প্রাণ হারায়।

১৪ ডিসেম্বর সকাল গড়িয়ে দুপুর। থেমে থেমে গুলির শব্দে বারবার প্রকম্পিত হচ্ছিল সাভার। সম্মুখযুদ্ধের উত্তেজনায় কিশোর টিটো গেরিলা যুদ্ধের আত্মরক্ষামূলক সতর্কতাও ভুলে যান। ইতোমধ্যে ৭-৮ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে। ঠিক তখনই পালিয়ে যেতে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া একঝাঁক গুলি এসে থামিয়ে দেয় কিশোর প্রাণের স্পর্ধা। শত্রু বাহিনীর এলএমজির আকস্মিক ফায়ারে লুটিয়ে পড়ে টিটোর সাহসী দেহ।

সেই যুদ্ধে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহের আলী বলেন, “আমরা বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে সতর্ক অবস্থান নেই। যুদ্ধ শুরু হলে টিটো আমার পাশেই যুদ্ধ করছিলেন। আমাদের আগ্রাসী আক্রমণে পাক হানাদার বাহিনী পিছু হটছিল। গোলাগুলিতে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হলে তারা পালাতে পালাতে পাল্টা গুলি করছিল। এর মধ্যেই টিটো মাথা তুলে গুলি করতে উদ্যত হয়। তখনই টিটোর শরীরের ডানদিকে গুলি লাগে।”

তিনি বলেন, “আহত টিটোকে আমরা উদ্ধার করি। একই সময় একজন পাক সেনাকেও আহত অবস্থায় ধরতে সক্ষম হই। মুমূর্ষু অবস্থায় টিটোকে পার্শ্ববর্তী একটি ডেইরি ফার্মে নিয়ে যাওয়া হয়। রক্তক্ষরণ বন্ধ করার মতো কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শহীদ হন টিটো। পরে সাভার ডেইরি ফার্ম গেটের কাছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়।”

বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি গেটের ঠিক বিপরীতে ফুটওভার ব্রিজের পাশে, সাভার ডেইরি ফার্মের ডানদিকে লাল সিরামিক ইটে বাঁধানো একটি সমাধি রয়েছে। সেখানে শায়িত আছেন শহীদ টিটো। সমাধির পাশে দুটি গাছ- একটি বকুল, অন্যটি কামিনী। ভিন্ন সৌরভের এই দুটি ফুলগাছ যেন মায়ের আঁচলের মতো ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছে তার শেষ বিশ্রামের স্থান।

সমাধির লাল ইটের দেয়ালে সাদা পাথরের ফলকে লেখা রয়েছে- “শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গোলাম দস্তগীর টিটো”। তার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সাভার সেনানিবাস ১৯৯৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর ‘টিটোর স্বাধীনতা’ নামে এই সমাধিস্থলটি নির্মাণ করে। একাত্তরের সেই চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ গোলাম দস্তগীর টিটোর রক্তে আরো লাল হয়েছিল সাভারের লাল মাটি।