বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন প্রকৃতি, পর্যটন ও পরিবেশ সংরক্ষণের টানাপোড়েনের এক অনন্য উদাহরণ। ২০২৫ সালজুড়েই এই দ্বীপ ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কখনো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার খবরে, কখনো আবার সীমিত আকারে খুলে দেওয়ার ঘোষণায়; কখনো কঠোর নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রশাসনের দৃঢ়তায়, আবার কখনো পর্যটকের অসচেতন আচরণে তৈরি হওয়া বিতর্কে।
১০ মাস পর আবারো পর্যটকের পদচারণা চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষার স্বার্থে সেন্টমার্টিনে পর্যটক প্রবেশ বন্ধ করে সরকার। দীর্ঘ প্রায় ১০ মাস পর ১ ডিসেম্বর ফের খুলে দেওয়া হয় দ্বীপের দুয়ার। তবে আগের মতো অবাধ নয়-নিয়ন্ত্রিত পর্যটন ব্যবস্থার আওতায়।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি-এই দুই মাস দৈনিক সর্বোচ্চ ২ হাজার পর্যটক দ্বীপে যেতে পারবেন। থাকবে রাত্রিযাপনের সুযোগও। তবে শর্ত একটাই- ১২ দফা কঠোর নির্দেশনা মেনে চলতে হবে সবাইকে।
নুনিয়ারছড়া জেটিঘাট থেকেই যাত্রার শুরু ১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৭টায় কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাট থেকে সেন্টমার্টিনগামী প্রথম জাহাজ ছেড়ে যায়। প্রথম দিনেই তিনটি জাহাজে প্রায় ১ হাজার ২০০ পর্যটক দ্বীপে যান।
২০২৩ সাল থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাতের কারণে টেকনাফের দমদমিয়া ঘাট ব্যবহার বন্ধ রয়েছে। পরবর্তীতে ইনানী নৌবাহিনী জেটিঘাট হয়। সেখানেও দীর্ঘস্থায়ী না হয়ে বর্তমানে নুনিয়ারছড়া ঘাট থেকেই নিয়মিত জাহাজ চলাচল করছে।
পর্যটন খুললেও থাকছে নিয়মের কড়াকড়ি বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের অনুমোদিত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কিউআর কোডযুক্ত ট্রাভেল পাস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিউআর কোড ছাড়া কোনো টিকিটকে বৈধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না।
এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের নজিরও মিলেছে মৌসুমের প্রথম দিনেই। ট্রাভেল পাস ছাড়া টিকিট বিক্রির দায়ে কেয়ারি সিন্দাবাদ জাহাজকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জেলা প্রশাসন।
পরিবেশ সুরক্ষায় ‘জিরো টলারেন্স’ দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এবার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পরিবেশগত বিধিনিষেধে। রাতের বেলা সৈকতে আলো জ্বালানো, উচ্চ শব্দে গান-বাজনা, বারবিকিউ পার্টি, কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ ও বিক্রি- সবই নিষিদ্ধ।
মোটরসাইকেল, সি-বাইকসহ সব ধরনের মোটরচালিত যান চলাচল বন্ধ। পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বহনেও রয়েছে কড়াকড়ি। পরিবেশ অধিদপ্তর ও ট্যুরিস্ট পুলিশ যৌথভাবে জাহাজ ঘাট ও দ্বীপে নিয়মিত নজরদারি চালাচ্ছে।
পর্যটকের চাপ, টিকিট সংকট রাত্রিযাপনের অনুমতি চালু হওয়ার পর ডিসেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহেই অন্তত ২১ হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করেছেন। আগ্রহ এতটাই বেড়েছে যে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব জাহাজের টিকিট আগাম বিক্রি হয়ে গেছে। প্রতিদিন যেখানে ৩ হাজারের বেশি মানুষ যেতে চাচ্ছেন, সেখানে সীমা থাকছে ২ হাজার।
হোটেল-গেস্টহাউস মালিকদের মতে, কক্সবাজারে আসা বিপুল সংখ্যক পর্যটকের বড় একটি অংশ সেন্টমার্টিন যেতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন।
শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনের দৃঢ়তা পর্যটক ব্যবস্থাপনায় কড়াকড়ির কারণেই ঘটেছে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। জাহাজ সূচি পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এক পর্যটকের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) প্রকাশ্যে গ্রেপ্তারের হুমকির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দেয়। তবে প্রশাসন স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়-সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে কোনো চাপই গ্রহণযোগ্য নয়।
জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান জানান, পর্যটকদের নিরাপত্তা, হয়রানি রোধ ও পরিবেশ সংরক্ষণ-এই তিনটি বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
স্থানীয়দের প্রত্যাশা-সময় বাড়ুক সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুর আহমদসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের আশা, রাত্রিযাপনের সুযোগ অন্তত চার মাসে বাড়ানো হবে। এতে একদিকে স্থানীয় অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রিত পর্যটনের মাধ্যমে পরিবেশও সুরক্ষিত থাকবে।
টিকিট প্রতারণা রোধে নজির: ক্ষতিপূরণসহ ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা ফেরত চলতি মৌসুমে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ ঘিরে টিকিট প্রতারণার অভিযোগেও সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। টিকিট দেওয়ার কথা বলে প্রতারণার শিকার হওয়া পর্যটকেরা ক্ষতিপূরণসহ মোট ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা ফেরত পেয়েছেন।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের প্রধান (অতিরিক্ত ডিআইজি) আপেল মাহমুদ জানান, গত ১৯ ডিসেম্বর পঞ্চগড় থেকে আসা একদল শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ‘ট্যুর প্লাস’ নামের একটি ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান সেন্টমার্টিনগামী জাহাজের টিকিট বাবদ ১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা নেয়। তবে বারবার আশ্বাস দিলেও ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের টিকিট দেওয়া হয়নি।
অভিযোগের পর ট্যুরিস্ট পুলিশ ওই প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তাকে আটক করে। পরে ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে সমঝোতার ভিত্তিতে টিকিটের টাকা ১ লাখ ৫৪ হাজার এবং অতিরিক্ত দুই দিন থাকা-খাওয়ার খরচ বাবদ ৭৬ হাজার টাকা ফেরত দেওয়া হয়।
পর্যটকদের অনুরোধে আটক ব্যক্তিদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলেও সংশ্লিষ্ট ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করে জেলা প্রশাসন ও ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের কাছে পত্র পাঠানো হয়েছে।
শামীম ইসলাম নামের এক পর্যটক বলেন, “ট্যুরিস্ট পুলিশের দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। এ ধরনের নজরদারি থাকলে পর্যটকেরা নিশ্চিন্তে কক্সবাজার ভ্রমণ করতে পারবেন।”
সবমিলিয়ে ২০২৫ সাল সেন্টমার্টিনের জন্য ছিল এক নতুন বাস্তবতার বছর। অবাধ পর্যটন থেকে সরে এসে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা-এই রূপান্তর সহজ নয়। তবু সরকার, প্রশাসন ও সচেতন পর্যটকদের সম্মিলিত প্রয়াসে সেন্টমার্টিনকে টিকিয়ে রাখার এই প্রয়াস ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। প্রশ্ন একটাই, পর্যটক হিসেবে আমরা কি প্রকৃতির অতিথি হয়ে উঠতে পারব? উত্তরটাই নির্ধারণ করবে সেন্টমার্টিনের আগামীর পথচলা।