বিপিএল ২০১৯

অবিশ্বাস্য রাসেলে ফাইনালে রাজশাহী

অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়, অপ্রতিরোধ্য। এভাবেও একা ম্যাচ জেতানো যায়! একা উড়িয়ে দেওয়া যায় কোনো প্রতিপক্ষকে? আন্দ্রে ডোয়াইন রাসেল প্রমাণ করলেন, চেষ্টা আর সামর্থ্য থাকলে সব সম্ভব। ওহ, সাথে প্রয়োজন শক্তিরও! মিরপুরে রীতিমতো তাণ্ডব চালিয়েছেন রাজশাহী রয়্যালসের অধিনায়ক। ২২ বলে অপরাজিত ৫৪ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে রাজশাহীকে তুলেছেন বঙ্গবন্ধু বিপিএলের ফাইনালে। শুক্রবারের ফাইনালে রাজশাহীর প্রতিপক্ষ খুলনা টাইগার্স। শের-ই-বাংলায় বুধবার সেমিফাইনালে পরিণত হওয়া ম্যাচে আগে ব্যাটিং করতে নেমে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স করে ৯ উইকেটে ১৬৪ রান। জবাবে ৪ বল হাতে রেখে ২ উইকেটের জয় নিশ্চিত করে রাজশাহী।

বিস্ফোরক ইনিংসে রাসেল দলকে তুলেছেন ফাইনালে। ডানহাতি ব্যাটসম্যান যখন ক্রিজে আসেন, তখন ৪০ বলে ৮৫ রান লাগত রাজশাহীর। সেখান থেকে ৫৪ রানের বিস্ফোরক ইনিংস উপহার দিয়ে রাসেল চমকে দেন চট্টগ্রামকে। মাত্র ২ চার ছিল তার ইনিংসে। বল হাওয়ায় ভাসিয়ে মাঠের বাইরে পাঠিয়েছেন ৭ বার। ২৪৫.৪৫ স্ট্রাইক রেটের ইনিংসে ওলটপালট চট্টগ্রাম। লক্ষ্য তাড়ায় লিটন ও আফিফের থেকে বড় কিছুর আশায় ছিল রাজশাহী। এর আগে সাতবার তাদের জুটির রান পঞ্চাশ ছাড়ায়। এবার তেমন কিছুর প্রত্যাশায় ছিল পদ্মাপাড়ের দলটি। কিন্তু দুর্দান্ত রুবেলে জমেনি তাদের জুটি। নতুন বলে দ্বিতীয় ওভারে বোলিংয়ে এসে রুবেল ফেরান আফিফকে। দ্রুতগতির শর্ট বলে মিডউইকেটে ক্যাচ দেন আফিফ। পরের ওভারে মেহেদী হাসান রানাকে চ্যালেঞ্জ করে রান আউটে কাটা পড়েন লিটন। নিজের বোলিংয়ে ফিল্ডিং করে সরাসরি থ্রোতে লিটনকে সাজঘরের পথ দেখান লিটন। দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে শুরুতেই ব্যাকফুটে চলে যায় রাজশাহী। রানের চাকা থেমে যায়। পাওয়ার প্লেতে আসে না বাউন্ডারি। ৬ ওভারে তাদের রান মাত্র ৪০। শেষ ওভারে মাহমুদউল্লাহ তুলে নেন অলক কাপালিকে।

উইকেটে এসে শোয়েব মালিকও পারেননি প্রয়োজন মেটাতে। অন্যপ্রান্তে থাকা ইরফান শুক্কুর বলপ্রতি নিচ্ছিলেন রান। মাঝে ২৭ বলে কোনো বাউন্ডারি আসেনি তাদের জুটিতে। দ্রুত রান তুলতে গিয়ে ১৪তম ওভারে শোয়েব মালিক উইকেট বিলিয়ে আসেন।

জিয়াউর রহমানের বল স্লগ করতে গিয়ে মাহমুদউল্লাহর হাতে ক্যাচ দেন মালিক (১৪)। ৪৭ বলে ৪৬ রান আসে এ জুটিতে। মালিকের বিদায়ের পর ক্রিজে অসেন রাসেল। সেখান থেকে হার্ডহিটার ব্যাটসম্যান একাই পাল্টে দেন সব হিসাব। শুরুর ৫ বলে ২ রান আসে তার ব্যাট থেকে। ১৫তমও ওভারের শেষ বলে মেহেদী হাসান রানাকে ছক্কায় উড়িয়ে আগ্রাসন দেখানো শুরু। ইরফান শুক্কুর ৪২ বলে ৪৫ রানের মন্থর ইনিংস খেলে বিদায় নিলে রাসেলের সঙ্গী হন মোহাম্মদ নওয়াজ। ৯ বলে ৩৩ রানের জুটি নওয়াজ ও রাসেলের। সেখান থেকেই চট্টগ্রামের ম্যাচ হাতছাড়া হওয়া শুরু। নওয়াজকে (৫ বলে ১৪) ফিরিয়ে রায়ান এমরিট রাজশাহী শিবিরে আঘাত করেছিলেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। রুবেল ১৮তম ওভারে চারটি ডেডলি ইয়র্কারে রাসেলকে থামিয়ে রেখেছিলেন। ওই বলের উত্তর জানা ছিল না এ হার্ডহিটারেরও কিন্তু শেষ বলে ছক্কা হজম করে রুবেল বিপিএল শেষ করেন। শেষ দুই ওভারে রাজশাহীর লাগত ৩১ রান। এর আগে ফরহাদ ও কামরুল ইসলাম রাব্বী এলোমেলো শটে দলকে বিপদে ফেললেও রাহী ছিলেন মনোযোগী। থার্ড ম্যান অঞ্চলে বল পাঠিয়ে এক রান নিয়ে রাসেলকে স্ট্রাইকে ফেরান। পরের ৫ বলে ২২ রান তুলে শেষ ওভারে লক্ষ্য ৮ এ নামিয়ে আনেন রাসেল ও রাহী। বাঁহাতি পেসারের দ্বিতীয় বল লং অন দিয়ে ছক্কা উড়ান রাসেল। পরের বলে কভার দিয়ে চার। চতুর্থ বল লং অফ দিয়ে গ্যালারিতে। পঞ্চম বলে স্ট্রাইক রোটেট করে এক রান নেন রাসেল। শেষ বলে রাহীর ব্যাটে আসে চার রান। ম্যাচ জয় নিশ্চিত হয়ে যায় রাজশাহীর। নিয়মিত বোলারদের আগে বোলিংয়ে পাঠিয়েও কোনো লাভ পাননি মাহমুদউল্লাহ। তাইতো শেষ ওভারে আশেলা গুনারত্নেকে নিয়ে আসেন। প্রথম দুই বল ডট করেছিলেন শ্রীলঙ্কান মিডিয়াম পেসার। তৃতীয় বল ওয়াইড। পরের বল নো। কিন্তু বল রাসেল উড়িয়ে মারেন গ্যালারিতে। ওই ছক্কায় জয়ের বন্দরে রাজশাহী। লক্ষ্য তাড়ায় ১৫ ওভারে তাদের রান ছিল ৮৯। সেখান থেকে পরের ২৬ বলে ৭৬ রান তুলে চট্টগ্রামের শিরোপার স্বপ্ন লন্ডভন্ড করে দেন ব্যাটিং দানব রাসেল। এর আগে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমেছিল চট্টগ্রাম। বিপিএলের বড় ম্যাচে বেশিরভাগ সময়ই জ্বলে উঠে ক্রিস গেইলের ব্যাট। এবারও হাসলেন গেইল। মোহাম্মদ ইরফানের করা প্রথম ওভার ছিল মেডেন। পাকিস্তানি পেসারের গতি ও বাউন্সে জিয়াউর রহমান ছিলেন নড়বড়ে। দ্বিতীয় ওভারে গেইল আবু জায়েদ রাহীর বলে দুই চার ও এক ছক্কা মেরে ১৬ রান তুলে পুষিয়ে দেন।

তৃতীয় ওভারের প্রথম বলে ইরফানকে মিডউইকেট গিয়ে উড়িয়েছেন জিয়াউর। কিন্তু ওই ওভারের শেষ বলে ইরফানের শরীরের ওপর তাক করা বাউন্সার উইকেটে টেনে আনেন। চতুর্থ ওভারে আবার গেইল ঝলক। এই ওভারে তিন চার ও এক ছক্কায় ১৮ রান তুলে গেইল রানরেট ঠিক রাখেন।

পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে বোলিংয়ে আসেন রাজশাহীর অধিনায়ক আন্দ্রে রাসেল। প্রথম বলেই পেয়ে যান উইকেট। চট্টগ্রামের ধারাবাহিক পারফরমার ইমরুল কায়েস রাসেলের শর্ট বল পুল করতে গিয়ে ক্যাচ দেন সীমানায়। দ্রুত ২ উইকেট হারালেও ৬ ওভারে চট্টগ্রামের রান ৫৮।

পাওয়ার প্লের পরও ব্যাট চালাতে থাকেন গেইল। পেসার কামরুল ইসলামকে সপ্তম ওভারের প্রথম দুই বলে উড়িয়েছেন সীমানায়। পরের ওভারে মাহমুদউল্লাহ রাসেলকে মিডউইকেটে গিয়ে বল পাঠান গ্যালারিতে। পরের বল লং অন দিয়ে বাউন্ডারিতে। গেইল ২১ বলে ফিফটিতে পৌঁছার পর নওয়াজ ও আফিফকে তুলে মারেন গ্যালারিতে। কিন্তু তাকে থামানোর উত্তর জানা ছিল অফ স্পিনার আফিফের।

একটু টেনে দেওয়া শর্ট বল। ছিল না গতি। বলও ঘোরেনি। গেইল বড় শট খেলতে গিয়ে বল মিস করে হন বোল্ড। বাঁহাতি ওপেনার ২৬ বলে ৬০ রান করে আউট হন। ৫ ছক্কা আর ৬ চারে সাজানো তার ইনিংসের স্ট্রাইক রেট ছিল ২৫০.০০। আফিফের ওই ওভারে চতুর্থ ও পঞ্চম বলে দুই ছক্কা হাঁকিয়ে মাহমুদউল্লাহ ওভারে তুলে নেন ২০ রান।

গেইলের পর মাহমুদউল্লাহর ব্যাটেও ছিল ঝড়। কিন্তু চট্টগ্রামের অধিনায়ক পথ হারিয়ে বসেন নওয়াজের বলে। বাঁহাতি স্পিনারের আর্ম বল ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে বোল্ড হন। ১৮ বলে ৩ চার ও ৩ ছক্কায় সাজানো ইনিংসটি ছিল ৩৩ রানের।

মাহমুদউল্লাহ যখন আউট হন তখন চট্টগ্রামের রান ১০.২ ওভারে ১১৩। সেখান থেকে পরের ৫৮ বলে চট্টগ্রাম যোগ করতে পারে মাত্র ৫১ রান। হারায় ৫ উইকেট। রাজশাহীর দুর্দান্ত বোলিংয়ের সঙ্গে অসাধারণ ফিল্ডিংয়ে রানের চাকা থেমে যায় চট্টগ্রামের। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারানোয় ২২ গজে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল তাদের।

নওয়াজ মাহমুদউল্লাহকে ফেরানোর পর সোহানকে এলবিডব্লিউ করেন শূন্য রানে। চাদউইক ওয়ালটন পারেননি দলের দাবি মেটাতে। অলক কাপালির বলে লিটন দাসের দুর্দান্ত ক্যাচে আউট হন ৫ রানে।

এরপর চট্টগ্রামের রান বাড়িয়েছেন শ্রীলঙ্কার আশেলা গুনারত্নে। তার ২৫ বলে ৩১ রানের ইনিংসে বড় মঞ্চে লড়াকু সংগ্রহ পায় বন্দরনগরীর দলটি।

প্রথম ৬ ওভারে চট্টগ্রামের ইনিংসে সিঙ্গেল ছিল কেবল একটি। পুরো ইনিংসেই স্ট্রাইক রোটেট করতে ভুগেছে তাদের ব্যাটসম্যানরা। ফলে ইনিংসে ডট বলও ছিল বেশি। ১২০ বলের মধ্যে ৬৪টিতে কোনো রান নিতে পারেনি চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স।

লড়াকু সংগ্রহের পর বোলিংয়েও ভালো করেছিল চট্টগ্রাম। কিন্তু রাসেলের দিনে শেষ হাসি অন্য কেউ কি হাসতে পারে? 

   

ঢাকা/ইয়াসিন/পরাগ