ক্যাম্পাস

সত্যায়ন ঔপনিবেশিক হয়রানি

জিএম আদল : সত্যায়ন পদ্ধতির আইনি কোনো ভিত্তি আছে বলে আমার জানা নেই। এটি কেবলই একটি ঔপনিবেশিক প্রথা। আর এ প্রথার জন্য লাখো তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপ্রার্থী, চাকরিপ্রার্থী এমন অন্যায় করতে বাধ্য হচ্ছেন, অন্যায়ের হাতেখড়ি শিখছেন।

২০১৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ভারতেও এ পদ্ধতিটির প্রচলন ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা কর্তৃক সত্যায়ন পদ্ধতি বাতিল করা হয়।

ভারতের মতো বাংলাদেশও এই সত্যায়ন পদ্ধতি বাতিল করা হোক এবং সত্যায়ন নামের এই মিথ্যায়নের বিড়ম্বনা থেকে লাখ তরুণ এবং সাধারণ মানুষকে রেহাই দেয়া হোক।

কিছুদিন আগে গ্রাম থেকে আমার এক ছোট ভাই ঢাকা এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হতে। ঢাকায় আমি ছাড়া ওর তেমন পরিচিত কেউ নেই। ভর্তি হতে যাবার আগের দিন আমার কাছে এসে বললো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ওর ছবি আর কাগজপত্র সত্যায়িত করে দিতে হবে। আমি বললাম ঠিক আছে তুই ওগুলো রেখে যা, আমি রাতে আমার বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে সত্যায়িত করে এনে দেবো। তুই সকালে এসে নিয়ে যাস। আমি আমার কোনো কিছু সত্যায়িত করার প্রয়োজন হলে ওনার কাছ থেকে করিয়ে রাখি, যেহেতু উনি একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা।

ছোট ভাইটা আমাকে বললো ভাইয়া আমাকে এখনি সত্যায়ন করে দেন, কাল সকালেই আমার ভর্তি, এদিকে সকালে আসার সময় পাব না,আপনিই সাইন দিয়ে সত্যায়ন করে দেন। আমি ওকে বললাম, আমি তো প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা না যে আমার সাইনে সত্যায়িত হবে। আমি এই কথা বলা মাত্রই সে তার পকেট থেকে একখানা সিল বের করে আমাকে দিয়ে বললো ভাই এটা নীলক্ষেত থেকে ৫০ টাকা দিয়ে বানিয়ে এনেছি, আপনি এই নামে একটা সাইন দিয়ে দেন। আমি সাইন দিতে রাজি হইনি একারণে সে রাগ করে চলে গেছে। কয়েক মাস পরে হঠাৎ ওর সাথে আমার দেখা। ওই বললো ভাই ওইদিন আপনি সাইন দেন নাই পরে আমি নিজেই সাইন দিয়া সত্যায়ন করে নিছিলাম। আর ওই সাইনের সত্যায়িত কাগজ পত্র দিয়েই আমি ভর্তি হইছি।

পরে আমি ভেবে দেখলাম, যারা সত্যায়ন নামে এমন মিথ্যায়নের আশ্রয় নেয়, তারা এমন করবেই না কেন?

তারা তো এমনিতেই এমন করেন না। আমি এমন অনেক প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাকে দেখেছি, যারা নানা অজুহাতে সত্যায়ন করে দিতে অপারগতা স্বীকার করেন। এর পিছেনও যৌক্তিক কারণ আছে। যে ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি জানেন না, তার সত্যায়ন তিনি কীভাবে করবেন, করেও আবার কোন বিপদে পড়েন। এই দায় এড়ানোর জন্য অনেকে সত্যায়ন করে দিতে রাজী হয় না হয়তো।

ফলে সত্যায়ন নামের মিথ্যায়ন করতে একধরনের বাধ্য হচ্ছে দেশের এই সাধারণ মানুষেরা। ইচ্ছায় করুক আর প্রয়োজনের তাগিদে করুক আইনের দৃষ্টিতে এটি প্রতারণা, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

চাকরির ক্ষেত্রে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে ছবি এবং কাগজ পত্রের সত্যায়ন চাওয়া হয়।

সত্যায়নকারী আর সত্যায়ন প্রার্থী উভয়ের জন্য এটি খুবই বিরক্তিকর এবং অপ্রয়োজনীয় কাজ বলে মনে হয়। এটি দেশবাসীকে হাতে ধরে চুরি শেখানোর মত। কারণ বিপদে পড়ে মানুষ অনেক সময় অন্যায় করে, মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এমনি একটি ব্যাপার এটি।

সত্যায়নের জন্য গেলে কিছু কর্মকর্তারা সত্যায়নপ্রার্থীকে ভিক্ষুকের চাইতেও নিচু স্তরের মনে করেন, যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করেন। সত্যায়ন প্রক্রিয়া মূলত জনগণের দাসভিত্তিক মানসিকতা ধরে রাখার জন্য একটি ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক দৃষ্টান্ত মাত্র।

চারিত্রিক সনদ জিনিসটাও একটা জঘন্য সিস্টেম বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, যিনি এটি দিচ্ছেন তার চরিত্র যে খুব ভালো, তার চরিত্র যে ফুলের মত পবিত্র এই গ্যারান্টিটা কে দিচ্ছেন?

একজন নতুন চাকরি প্রত্যাশী কিংবা নব্য বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ইচ্ছুক প্রার্থীকে এ নিয়ে চরম বিপাকে পড়তে হয়, মাঝে মাঝে হয়রানির শিকারও হতে হয়। এই হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে সত্যায়নের আড়ালে সত্যায়নের নামে বেশিরভাগ মানুষই মিথ্যায়ন এর আশ্রয় নেয়।

যেখানে বর্তমান সরকার অন্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিচ্ছে, সেখানে এটি আমাদের কাম্য নয়। জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা আইডি নম্বর দিয়েও সহজেই যেকোনো ব্যক্তিকে শনাক্ত করা যায়। একজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করার এত আধুনিক উপায় থাকা সত্ত্বেও কেনো এত হয়রানি?

এই প্রথা থেকে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত যদি বেড়িয়ে আসতে পারে, তবে আমরা কেনো নয়?

কাগজপত্রের ফটোকপিতে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার স্বাক্ষরের মাধ্যমে সত্যায়নের যে এই প্রক্রিয়া, তা নিতান্তই সেকেলে ও বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব দিক বিবেচনা করে হলেও সেকেলে এই সত্যায়ন প্রক্রিয়টি বন্ধ করা হোক।

লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট ও শিক্ষার্থী, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯/আদল/হাকিম মাহি