ক্যাম্পাস

পান চাষে বিপ্লবের সম্ভাবনা

বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা দিদারুল ইসলাম বেপারী। প্রাথমিক জীবনে তিনি চলচ্চিত্র কিনে বিভিন্ন সিনেমা হলে চালাতেন। সেখান থেকে যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার চালাতেন তিনি।

পরবর্তী সময়ে স্মার্টফোন, ইন্টারনেট এবং ইউটিউবের সম্প্রসারণের ফলে দেশের বিভিন্ন জায়গার অনেক সিনেমা হল বন্ধ হতে শুরু করে। ফলে তাঁর আয়ের পথ সংকুচিত হতে থাকে। পরিবারের ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার ব্যয়ভার, তার মায়ের চিকিৎসার খরচ চালানো তার জন‌্যে অসাধ‌্য হয়ে পড়ে।

পরবর্তী সময়ে তিনি পানের ব্যবসায় যারা সফল তাদের সাথে পরামর্শ করে কিছু জমি ইজারা নিয়ে পানের ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম দিকে তিনি অনেকটা লাভবান হয়েছিলেন। কিন্তু নদী ভাঙ্গনের ফলে তার প্রথম পানের বরজটি নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু তিনি হতাশ না হয়ে কৃষি ঋণ নিয়ে পুনরায় পানের ব্যবসা শুরু করেন।

জনাব দিদারুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে পানের চাষ একটি সম্ভাবনার ব্যবসা। পানের ব্যবসা করে অনেক দরিদ্র পরিবার বর্তমানে সাবলম্বী হচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকার যদি পান চাষীদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে কৃষি ঋণ দেন, তাহলে এই ক্ষেত্রে একটি বিপ্লবের সম্ভাবনা রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কৃষি ক্ষেত্রে অনেক অনুদান, ঋণ দেয়ার ব‌্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা পান চাষিরা সে সুবিধা পাই না।’

পান চাষের পদ্ধতি:

জনাব দিদারুল ইসলামের পানের বরজের একজন অভিজ্ঞ শ্রমিক রাকিব হোসেন পান চাষের বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে প্রতিবেদকের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে বিস্তারিত আলোচনা ও তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন।

রাকিব হোসেন বলেন, ‘পান একপ্রকার গুল্মজাতীয় গাছের পাতা। পান চাষের জন্য যেমন বিশেষ ধরনের জমির প্রয়োজন, তেমনি প্রচুর যত্নেরও দরকার হয়। পান চাষের জন্য নির্বাচিত জমি সাধারণত একটু উঁচু, মাটির ধরন শক্ত এবং জলাশয় ও পুকুর ইত্যাদির ধারে কাছে হওয়া বাঞ্ছনীয়। পানের বাগানকে বলা হয় বরজ এবং একটি বরজের আয়তন সাধারণত বারো থেকে কুড়ি শতাংশের মধ্যে হয়ে থাকে। পানের বরজ তৈরির জন্য পাশের কোনো জমি থেকে মাটি কেটে বরজের স্থানে ফেলে জায়গাটিকে উঁচু করে নিতে হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রথাগতভাবে বরজে সরিষার খৈল ও গোবরকে সার হিসেবে ব্যবহার করা হত। চাষের উপযোগী করে জমিকে তৈরি করার পর মে ও জুন মাসে পানের লতা রোপণ করা হয়। মাঝখানে দুই ফুট দূরত্ব রেখে চারাগুলো সমান্তরাল লাইনে রোপণ করা হয় এবং পরে বাঁশের শলা বা খুঁটি পুঁতে তার সাথে পানের লতাগুলো জড়িয়ে দেয়া হয়।’

রোদ এবং গরু-ছাগলের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বরজের চারদিকে ৫/৬ ফুট উঁচু করে বাঁশের শলা ও খুঁটি দিয়ে বেড়া এবং একই সামগ্রী দিয়ে উপরে চালা তৈরি করা হয়। শুকনা মৌসুমে পান গাছে নিয়মিত পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। চারা রোপণের এক বছর পর পান আহরণের উপযোগী হয় এবং বরজ তৈরির পর কয়েক বছর পর্যন্ত তা থেকে উৎপাদন অব্যাহত থাকে।

   

পান গাছে কমপক্ষে ষোলটি পান রেখে বাকি পান পাতা আহরণের নিয়ম। পাতার আকার, কোমলতা, ঝাঁজ, সুগন্ধ ইত্যাদির বিচারে বহু ধরনের পান রয়েছে। যেমন- তামাক (তামবুকা) পান, যা তামাক ও মসলা বা জর্দা যুক্ত, সুপারি (সাদা) পান, মিষ্টি (মিঠা) পান, সাঁচি পান প্রভৃতি।

বাংলা পানকে অনেকে মিঠা পান, ঝাল পা, রাজশাহীর পান বলেও অভিহিত করা হয়। এছাড়া, সাধারণ জাতের পানের মধ্যে রয়েছে বাংলা, ভাটিয়াল, ঢাল-ডোগা এবং ঘাস পান ইত্যাদি। সাধারণত পানের সাথে চুন এবং সুপারি মিলিয়ে খাওয়া হয়। অনেকে আবার পানের সাথে ধনিয়া, এলাচি, দারুচিনি এবং অন্যান্য সুগন্ধি দ্রব্য মেশায়। উল্লেখ্য জনাব রাকিব হোসেন স্থানীয় একটি এনজিও থেকে পান চাষের পদ্ধতির সম্পর্কে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি।

পান চাষের সোনালী ইতিহাস:

নিশ্বাসকে সুরভিত করা এবং ঠোঁট ও জিহ্বাকে লাল করার জন্য মানুষ পান খান। অবশ্য পানে কিছুটা মাদকতার আনন্দও বিদ্যমান। প্রধানত দক্ষিণ এশিয়া, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষ পান খান।

বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে সামাজিক রীতি, ভদ্রতা এবং আচার-আচরণের অংশ হিসেবেই পানের ব্যবহার চলে আসছে। অনুষ্ঠানাদিতে পান পরিবেশন দ্বারা প্রস্থানের সময় ইঙ্গিত করা হয়। এক সময় উৎসব, পূজা ও পুণ্যাহে পান ছিল অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাচীন অভিজাত জনগোষ্ঠীর মাঝে পান তৈরি এবং তা সুন্দরভাবে পানদানিতে সাজানো লোকজ শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেত।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুসলমান শাসনামলে কৃষকদের মাঝে বারুই শ্রেণি ছিলো সবচেয়ে বেশি ধনী। ১৮৭২ এবং ১৮৮১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায় যে, সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পান উৎপাদনকারী বারুই বসবাস করত বর্ধমান, মেদিনীপুর, যশোর এবং ঢাকা জেলায় বর্তমানে পান উৎপাদনের সিংহভাগই হচ্ছে মুসলমান কৃষকদের হাতে। তবে উৎপাদন কৌশল অপরিবর্তিত রয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসকারী আদিবাসী/অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠির মধ্যে খাসি-রাই একমাত্র আদিবাসী, যাদের প্রধান পেশা পান চাষ। তারা পান চাষকে পানজুম বলেন। এদের উৎপাদিত পান অধিক সুস্বাদু ও ঝাঁঝ হওয়ায় এই পান সমগ্র সিলেট অঞ্চলে, এমনকি সিলেটের বাইরেও জনপ্রিয়।

বাংলাদেশ থেকে পান রপ্তানি করা হয় পাকিস্তান, ভারত, সৌদিআরব, আরব-আমিরাত, ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানিসহ এশিয়া-ইউরোপের আরও অনেক দেশে। বিদেশে রপ্তানীযোগ্য পান আনা হয় বাংলাদেশের নাটোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা প্রভৃতি জেলা থেকে। তবে ঢাকার অদূরে শ্যামবাজারে প্রচুর পানের আড়ত রয়েছে, যা রপ্তানির জন্য বেশি উৎকৃষ্ট নয়। বাংলাদেশ ১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে ইউরোপে পান পাঠানো শুরু হয়। সৌদি আরবে পান পাঠানো হয় ১৯৯১ সাল থেকে। মূলত বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের লোকজনই বিদেশে বাংলাদেশের পান কিনে খায়।

বাংলাদেশে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ধরনের পান খেয়ে থাকে। তন্মধ্যে ঢাকাই খিলিপান বাংলাদেশ ও উপমহাদেশে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। হিন্দুদের পূজায়ও পান ব্যবহৃত হয়। তাছারা বয়োবৃদ্ধ মহিলারা পানদানিতে পান রেখে তাদের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় স্বজনের সাথে অবকাশ যাপন করে থাকেন।

পানের উৎপাদনে অধিক পুঁজি বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে এতে আয়ও যথেষ্ট। পানে এক ধরনের সুগন্ধ থাকার কারণে পানের বরজ ক্ষতিকর প্রাণি বা কীটপতঙ্গ দ্বারা কখনও আক্রান্ত হয় না। সুতরাং পান বরজের আয় নিশ্চিত।

বর্তমানে পানের বিশ্বব্যাপী বাজার রয়েছে। এই বাজার প্রসারে দুটো বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ার পানসেবীদের বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া; দ্বিতীয়ত, পানের ভেষজ গুণাগুণের বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি। বিশ্ববাজারে ভারতের সাথে প্রতিযোগী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বাজারের একটি ক্ষুদ্র অংশ দখল করতে পেরেছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ। ঢাকা কলেজ/রায়হান হোসেন/হাকিম মাহি