ক্যাম্পাস

এক কিংবদন্তির নোবেল না পাওয়ার গল্প

মহাকাশ বিজ্ঞানকে শত বছর এগিয়ে দেয়া একবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন উইলিয়াম হকিং মারা যান ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ। তার মৃত্যুর পর বড় বড় পত্রিকাগুলোতে মৃত্যু সংবাদ ছাপার পাশাপাশি বড় আকারে শিরোনামে ছিলো হকিংয়ের নোবেল পুরস্কার না পাওয়ার বিষয়টি।

স্টিফেন হকিংয়ের নাম শোনেননি অথচ জ্ঞান-বিজ্ঞানে আগ্রহ আছে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কৃষ্ণ গহ্বর এবং আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে তার কাজের জন্য তিনি বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিলেন। বিন্দু বিসর্গ বিজ্ঞানের জ্ঞান নেই যাদের, সেই জনসাধারণের জন্য মহাবিশ্বের জটিল তত্ত্বকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা ছিলো এই প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানীর। হকিং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল কসমোলজির গবেষণা প্রধান ছিলেন। তিনি ১৯৭৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের লুকাসিয়ান অধ্যাপক ছিলেন।

এক সময় এই পদ অলংকৃত করেছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। হকিং মাত্র ২১ বছর বয়সে মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হয়েও পূর্ণোদ্যমে চালিয়ে গিয়েছেন নিজের গবেষণা। হকিংয়ের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং বোর-হাইজেনবার্গের কোয়ান্টাম তত্ত্বকে মিলিয়ে দেয়া। হকিং কৃষ্ণবিবরের ঘটনা দিগন্তের ঠিক বাইরে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি প্রয়োগ করে দেখান যে কৃষ্ণবিবর থেকে বিকিরিত হচ্ছে কণা প্রবাহ। এই বিকিরণ এখন ‘হকিং বিকিরণ’ নামে পরিচিত।

আলফ্রেড নোবেল মানবজাতির কল্যাণে কাজ করা ব্যক্তিদের পুরস্কারের জন্য যে উইল রেখেছেন, সেখানে ২টি শর্তের কথা বলা আছে। যে তত্ত্বের জন্য নোবেল দেওয়া হবে, সেই তত্ত্বটি হতে হবে ‘বাস্তবিক বা ব্যবহারিকভাবে প্রমাণিত’। অর্থাৎ সহজ ভাষায়, শুধু খাতা কলমে তত্ত্ব থাকলেই হবে না, তত্ত্বটির ব্যবহারিক নিশ্চয়তা প্রমাণিত হতে হবে। আর দ্বিতীয় শর্তটি হলো এই যে, নোবেল পুরস্কার শুধু জীবিত ব্যক্তিকেই দেয়া যাবে। মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার দেয়া হবে না।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে ‘দ্য সায়েন্স অব লিবার্টি’ বইয়ের লেখক টিমোথি ফেরিস হকিংয়ের নোবেল না পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। টিমোথি ফেরিস লিখেছেন, স্টিফেন হকিংয়ের ‘ব্ল্যাক হোলও মরতে পারে’ তত্ত্ব এখন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে ব্যাপকভাবে মেনে নেয়া হয়েছে। টিমোথি আরো বলেন, একটি ব্ল্যাকহোলের জীবন অনেক দীর্ঘ হয়। তাই শত কোটি বছরেও কোনো ব্ল্যাকহোলের মৃত্যুদশা দেখা সম্ভব না। একারণেই তত্ত্বটি প্রমাণ করা আপাতত অসম্ভব।

নোবেল পুরস্কার নিয়ে হকিংয়ের আগ্রহের কথা অনেক শোনা যায় শেষ কয়েক বছরে। এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন- ‘যদি কম ভরের কৃষ্ণগহ্বর আবিষ্কৃত হয়, তাহলেই আমি নোবেল পুরস্কার পেয়ে যাব।’

কিংবদন্তি বিজ্ঞানীর নোবেল না পাওয়ার পেছনে ছিলো একটাই কারণ, সারা জীবন ধরে যে 'হকিং বিকিরণ' এর কথা বার বার বলে এসেছেন, তিনি সেই বিকিরণ মাপার মতো কারিগরি দক্ষতা এখনো মানুষের আয়ত্ত হয়নি।

নোবেল পুরস্কার ছাড়া আর সব পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন হকিং। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার একটি আবক্ষ মূর্তি আছে। সেখানে তার নামে একটা ভবনও আছে। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনেও তার একটি মূর্তি আছে। এল সালভাদরের রাজধানী সান সালভাদরের বিজ্ঞান জাদুঘরটির নাম ‘স্টিফেন হকিং বিজ্ঞান জাদুঘর’। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রানি তাকে 'অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার' এবং অর্ডার অব দ্য কম্প্যানিয়ন' অনারে ভূষিত করেছেন। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পদক। পেয়েছেন তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের সর্বোচ্চ সম্মান আলবার্ট আইনস্টাইন পদক।

কিছু মানুষ তাদের কাজের কারণে এতটাই বড় যে অনেক সময় সবচেয়ে বড় পুরস্কারগুলোও তাদের জন্য ছোট হয়ে যায়। নোবেল তাই অধরাই থাকলো এই পদার্থ পণ্ডিতের। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো তার তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ করবো আমরা।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। কুবি/আনিকা/হাকিম মাহি