ক্যাম্পাস

কোথায় পাব মানবতা?

আমরা মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আমার মতো আর পাঁচটা লোককে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব কেন? তাহলে প্রায় সবার কাছ থেকে একই উত্তর আসবে সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে আলাদাভাবে জ্ঞান-বুদ্ধি নামক একটা জিনিস দিয়েছেন, যা আমাদেরকে ভিন্ন করেছে অন্য সব প্রাণী থেকে। এই পৃথিবীতে একমাত্র আমরাই নিজেদের বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ভালো-মন্দকে আলাদা করতে পারি।

সৃষ্টির এই শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে আমরা নিজেদের বিবেককে কখন যে জলাঞ্জলি দিয়েছি, তা হয়তো আমরা নিজেরাই জানি না। যদি আমরা বর্তমান সমাজের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, শ্রেষ্ঠত্বের দাম্ভিকতা আমাদের মনুষ্যত্বকে কীভাবে গলা টিপে মেরে ফেলেছে।

পৃথিবীর বুকে সব থেকে মমতাময়ী নাম হলো মা। সব থেকে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেন প্রতিটি মা। কিন্তু আজ বৃদ্ধ বয়সে তাদের জায়গা হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। নিজ সন্তান মাকে ফেলে রেখে যাচ্ছেন ডাস্টবিনে। এই আমাদের শ্রেষ্ঠ হওয়ার নমুনা, এই হলো আমাদের মানবতা আর মূল্যবোধ।

যে পিতা-মাতার জন্য এই দুনিয়ার আলো দেখলাম, যাদের যত্নে বড় হয়েছি, আজ বৃদ্ধ বয়সে তাদেরকেই ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি রাস্তায়। কত বড় অকৃতজ্ঞ আমরা। যে মমতাময়ী মায়ের চোখ উজ্জ্বল হতো সন্তানের ছোট ছোট সাফল্যে, আজ তার চোখের পাতা ভেজে সন্তানের অবহেলার কারণে।

এখন তো আমরা অনেক বেশি সামাজিক হয়েছি, শিক্ষার হার বেড়েছে অনেক। কিন্তু সাথে সাথে কমেছে আমাদের মূল্যবোধ। এই শিক্ষিত সমাজে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু, ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা। এই হলো আমাদের শিক্ষিত সমাজের নমুনা। যেখানে নিজ সন্তানের হাতে খুন হয় পিতা, আর শিশু সন্তানকে হত্যা করছে তার নিজের বাবা। এই হলো আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থা।

আজ সামাজিক ব্যবস্থার কেন এই অবনতি, এই সামাজিক অবক্ষয়ের দায়ভার কার? এই দায়ভার কি পিতা-মাতার? কারণ, সন্তানের শিক্ষা প্রদানের গুরুদায়িত্ব পিতা-মাতার সবচেয়ে বেশি। হয়তো বা তাদের সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দেয়নি বলেই বৃদ্ধ বয়সে তাদের জায়গা হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে, লাঞ্ছিত হচ্ছে নিজ সন্তানের কাছে। নাকি দায়ভার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থা কি তাহলে আমাদের মধ্যে সেই মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে পারছে না? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে?

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর হাতে খুন হচ্ছে আরেকজন শিক্ষার্থী। প্রকাশ্য দিবালোকে খুনাখুনি করছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অবস্থান করে যখন কোনো ছাত্রের মধ্যে মূল্যবোধ ও মানসিকতার এই রূপ অবক্ষয় দেখা যায়, তখন মনে শঙ্কা জাগে, তাহলে ১২ বছরের স্কুল কলেজের শিক্ষা তাদের ভিতর কি কোনো মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারেনি? মনের মধ্যে প্রশ্ন থেকেই যায়।

নাকি এই ধরনের সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ আমাদের দুর্বল সামাজিক ব্যবস্থা? একজন মানুষ দুর্নীতি করছে, খুন-ধর্ষণের মতো কাজে লিপ্ত হচ্ছে। তাহলে তার এই ধরনের মানসিকতা জাগ্রত হল কীভাবে? এটা কিন্তু চিন্তার বিষয়! হয়তো বা সে তার সমাজ ব্যবস্থার কাছ থেকে সেই রকম শিক্ষা পাচ্ছে না। ক্ষমতার লোভ অথবা অর্থ লিপ্সা তাদেরকে অনৈতিক পথে নিয়ে যাচ্ছে।

এই ধরনের মানুষের আলাদা কোনো পরিচয় নেই, এরা আমাদেরই কারো না কারো পিতা, ভাই, আত্মীয়-স্বজন, এরা নিশ্চয়ই কোনো মায়েরই সন্তান। এসব অপকর্ম ঠেকাতে আমাদের উচিৎ আগে নিজ নিজ পরিবার থেকে তাদের মধ্যে নৈতিকতাবোধ এবং মনুষ্যত্ববোধ সৃষ্টি করা। ছোটবেলা থেকে প্রত্যেকটি শিশুকে নৈতিক শিক্ষাসহ তাদের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করা, সামাজিক অনুশাসন শিক্ষা দেয়া। তাহলে হয়তো বা এই সমস্যা থেকে অনেকাংশেই মুক্তি পাওয়া যাবে।

প্রতিটি পরিবার যখন এই ধরনের অপকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, মাত্র তখনই আমরা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবো। আমাদের আইন রয়েছে, কিন্তু তার যথার্থ প্রয়োগ নেই। যখন আইনের যথার্থ প্রয়োগ হবে এবং বিচারব্যবস্থা আরও বেশি শক্তিশালী হবে, তখনই এইসব অপরাধের সংখ্যা অনেকাংশে কমে যাবে। অপরাধীরা অপরাধ করার আগে বারংবার ভাববে। কিন্তু যখন বিচারব্যবস্থা দুর্বল থাকবে, অপরাধীরা সঠিক বিচারের আওতায় আসবে না, তখনই অপকর্মগুলো একজনের দেখাদেখি আরও দশজন করার সাহস পাবে।

আসুন আমরা সবাই মিলে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। নিজেরা অপরাধ করবো না এবং অন্যকেও অপরাধ করতে দেবো না।

লেখক: শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। যবিপ্রবি/হাকিম মাহি