ক্যাম্পাস

‘ভ্রমণে জীবনের সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া যায়’

বাংলাদেশ ঘুরে দেখার প্রবল ইচ্ছা থেকেই তিনি ঘুরেছেন ৬৪ জেলার পথে-ঘাটে। ঘুরেছেন নগরে-প্রান্তরে, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর মানুষের ভালবাসার খোঁজে। মাত্র দেড় বছর সময়ে তিনি ঘুরেছেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া, পা ফেলেছেন দেশের ৬৪টি জেলায়।

বলছিলাম রায়হানের কথা। তার জন্ম বরিশালে, তবে তিনি বেড়ে ওঠেছেন ঢাকাতেই। বর্তমানে তিনি পড়াশুনা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে।

রায়হানের সাথে আলাপকালে জানতে চাইলাম তার বাংলাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা। প্রথমেই তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন মনে হলো বাংলাদেশটা ঘুরে দেখা দরকার?

এমন প্রশ্নের জবাবে রায়হান বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমরা বিভিন্ন ধরনের স্বপ্ন দেখি, আমি স্বপ্ন দেখতাম আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ঘুরে দেখার। যখন কিশোর বয়স পার হলো, তখন এই স্বপ্ন গভীর আসক্তিতে পরিণত হয়। ব্যাস, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পা দিতেই বেরিয়ে পড়লাম যাযাবরের মতো স্বপ্ন পূরণে। এছাড়াও নতুন নতুন জিনিস দেখা, শেখা এবং অর্জনের প্রতি আমার স্পৃহা হচ্ছে অদম্য। যেই কারণে বাংলাদেশটা ঘুরে দেখা।

কেউ ট্রাভেলার বললে কেমন লাগে?

এরকম প্রশ্নের উত্তর হবে জীবনের তাগিদে, সময়ের প্রয়োজনে, মানুষের ভালবাসার খোঁজে আমি পথে পথে ঘুরেছি। আমার মনে হয়, ভ্রমণের মাঝে জীবনের সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া যায়। কেউ আমাকে ট্রাভেলার বললে আমার শান্তি লাগে না। I'm neither a tourist nor a traveller, just a simple wanderer who roams for life, love and chill.

কেমন ছিল ভ্রমণের দিনগুলো?

ভ্রমণের দিনগুলির কথা চিন্তা করলেই নস্টালজিক হয়ে যাই। কত শত স্মৃতি জমা হয়েছে স্মৃতির পাতায়, বেড়েছে অভিজ্ঞতার ঝুলি। আমার ভ্রমণের দিনগুলো পুরোটাই ভালবাসায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিল। মানুষের মাঝে ভালোবাসা খুঁজে বেড়ানোই ছিল আমার কাজ। নতুন নতুন আগন্তুকের সাথে পরিচয় হয়ে তার মাঝে যেন আমার ভালোবাসা নিংড়ে দিতে পারি, সেই চেষ্টা করতাম।

আমি সলো ট্রাভেল করি, পুরো বাংলাদেশেই একা ঘুরেছি, পথিমধ্যে যাকে পেয়েছি, সেই সঙ্গী ছিল, হতে পারে সে আমার বন্ধু, ড্রাইভার, মাঝি, বৃদ্ধ লোক কিংবা আগুন্তুক। সবার সাথে মিশেছি প্রচুর। রেলস্টেশন, ফিলিং স্টেশন, মাজার, মসজিদ, বাসা, ভার্সিটি হল, হোস্টেল, মেস, থ্রি-স্টার হোটেলে, যেখানে রাত হয়েছে সেখানেই কাত হয়ে ঘুমিয়েছি। মসজিদের শিন্নি, মাজারের তবারক, মন্দিরের প্রসাদ খেয়েও ভ্রমণ করেছি। বিমান বাদে বাংলাদেশের সব ধরনের যানবাহনে ঘুরেছি। সব মিলিয়ে ভ্রমণের দিনগুলো ছিল অনন্য, বলতে একটি বই লিখে ফেলা যায়।

দেশ ঘুরে কী পেলেন?

কী পেলাম জানি না। তবে, আমি সারা বাংলাদেশ জুড়ে "Exploring Heritage" নামক রিসার্চ করেছি, যেখানে ২০০ এর অধিক প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট পরিদর্শন করেছি এবং জেনেছি। হেরিটেজ সাইট নিয়ে ভবিষ্যতে রিসার্চ পেপার লেখার ইচ্ছা আছে।

"Finding Tribals" নামক একটি সার্ভে করেছি, যেখানে বাংলাদেশের প্রায় ২০টি আদিবাসী/উপজাতি সম্পর্কে জেনেছি এবং এই সার্ভে চলমান থাকবে। বিভিন্ন আদিবাসীদের নিয়ে ব্লগ, ওয়েবসাইট, বই এবং জার্নালে লেখার ইচ্ছা আছে। "Frame of Bangladesh" নামক মোবাইল ফটোগ্রাফি করেছি বিভিন্ন জেলায়।

সারা বাংলাদেশ ঘুরে মোবাইল দিয়ে যতটুক সম্ভব কিছু ছবি তুলেছি, ৬৪ জেলার বিভিন্ন জায়গার ফটোগ্রাফি দিয়ে একটি চিত্র প্রদর্শনী করার ইচ্ছা আছে। "Revolutionary Bangladesh" নামক হেডলাইনে কিছু সচেতনতামূলক কাজ করার চেষ্টা করেছি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য "একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই, রক্ত দিন জীবন বাঁচান, Hang Rapist, Take Back Rohingyas, নিরাপদ সড়ক চাই, Save Sundarban"

শুরুর দিকটা কেমন ছিল?

শুরুর দিকে নিতান্তই শখের বশে ঘুরতাম, স্বপ্ন থাকলেও সারা বাংলাদেশ একা ঘুরার সাহস করে উঠতে পারতাম না। প্রথমে, ছোট ছোট ট্যুর দিতাম বিভিন্ন ট্রাভেল গ্রুপের সাথে। শুরুর দিকে অসম্ভব বলেছিল অনেকেই, তবে আমি হাল ছাড়িনি। আমার মনে হয়েছে চেষ্টা, কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য এবং সাধনা দিয়ে সব কিছু জয় করা সম্ভব। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পর একাই বেরিয়ে পরলাম মুসাফির বেশে। প্রায় দেড় বছর সময় লেগে গেল ৬৪ জেলা ঘুরতে। ৬৪ জেলা ভ্রমণের এই বিজয়, আমি বাংলাদেশের ৩০ লক্ষ শহীদ এবং সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি উৎসর্গ করছি। যাদের কারণে এই সুন্দর দেশটি পেয়েছি এবং পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি।

ট্রাভেলের প্রেরণা কী ছিল?

অবশ্যই বাবা-মা, আমার পরিবার আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। অনেক অভিভাবকরা ভাবেন, ট্রাভেলিং মানে অর্থের অপচয়। এছাড়াও সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ট্রাভেলিং করতে সম্মতি দেন না। যেটা মোটেই উচিৎ নয়। আপনার সন্তান ভিন্ন পরিবেশে নিজেকে অভিযোজিত করতে না শিখলে পরবর্তী জীবনে লড়াই করবে কীভাবে? আমার পরিবার এই দিক থেকে অনেক সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

বিভিন্ন জেলায় যারা আমাকে সাহায্য করেছেন তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি পরিবার ও সকল বন্ধুবান্ধব এবং ওয়েল উইশারদেরকেও ধন্যবাদ, যারা আমাকে উৎসাহিত করেছেন।

নেক্সট মিশন কী?

আমার নেক্সট মিশন "Walk for Climate Change" যেখানে বাংলাদেশের এক প্রান্ত তেঁতুলিয়া থেকে আরেক প্রান্ত টেকনাফ পায়ে হেঁটে যাব। সময় লাগবে প্রায় ৪০ দিন, পাড়ি দিতে হবে ১০০৪ কিলোমিটার পথ।

রায়হান ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে শুরু করেন নিজের চোখে বাংলাদেশ আবিস্কারের মিশন, শেষ হয় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে। তিনি বলেন, ৬৪ জেলা, দেড় বছর সময়, শ'খানেক আগন্তুক, ২০০ এর অধিক প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট, ৫৬ হাজার বর্গমাইলে পদচিহ্ন সব মিলিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা। মাত্র ২১ বছর বয়সে এমন একটা স্বপ্ন পূরণ করতে পারা আমার জন্য অনেক প্রাপ্তি এবং আনন্দের। কেউ জিজ্ঞেস করতে পারেন, প্রাপ্তিটা কী? প্রাপ্তিটা প্রতিটা জেলার মানুষের সাথে মিশতে পারা, ভিন্ন ভিন্ন সিচুয়েশনে অভিজ্ঞতা অর্জন করা।  রায়হান নিজেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে কম বয়সী ট্রাভেলার দাবি করেন, যে এভাবে ৬৪ জেলা ভ্রমণ করেছেন।

প্রায় দেড় বছর সময় ধরে অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা, পরিশ্রম, ধৈর্যের ফসল হিসেবে রায়হানের বাংলাদেশ ঘুরে দেখার স্বপ পূরণ  হয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 

রাবি/হাকিম মাহি