ক্যাম্পাস

নোবিপ্রবির ১০১ একর আমাদের গর্ব

ভোরের আলোয় আলোকিত হওয়ার সাথে সাথে জ্ঞান পিপাসু শিক্ষার্থীদের পদচারণায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠে ক্যাম্পাস। মনে হয় এ যেন এক জ্ঞান পিপাসুদের তীর্থভূমি। পরিবারের আপনজন ছেড়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শিক্ষার্থীদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়টি যেন মায়ের স্নেহভরা আঁচল। বলছিলাম উপকূলীয় অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) কথা।

রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১৭১ কিলোমিটার দূরত্বে নোয়াখালী জেলা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে সোনাপুর-সুবর্ণচর সড়কের পশ্চিম পাশে এটি অবস্থিত। ১০১ একর জায়গা জুড়ে কোলাহল আর যান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত পরিবেশে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। নোয়াখালী জেলার মানুষের সংগ্রামী জীবনে শিক্ষার প্রসারের জন্য ২০০৬ সালের ২২ জুন মাত্র ৪টি বিভাগ নিয়ে ২৭তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ৫ম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি।

প্রতি বছর এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে আসেন। তারা উৎসবমুখর পরিবেশ ও নোয়াখালীবাসীর আতিথেয়তায় সুষ্ঠুভাবে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।

আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গতিশীল যুগোপযোগী শিক্ষা, বৈচিত্র্যময় বিষয়ের সমন্বয়ে সাজানো হয়েছে এখানকার পাঠ্যসূচি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টি অনুষদ, ২টি ইনস্টিটিউট, ৩০টি বিভাগের অধীনে অধ্যয়নরত ৭ হাজার শিক্ষার্থী, প্রায় ৩ শতাধিক শিক্ষক এবং ৪ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত নোবিপ্রবি পরিবার।

বছরের শুরুতে নবীনদের বরণ, একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন, বসন্ত বরণ, স্বাধীনতা দিবস, নববর্ষ বরণ, পিঠা উৎসব, নারী দিবস, বিশ্ব পরিবেশ দিবস, ফার্মাসিস্ট দিবস, ডিএনএ দিবস, বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী, শোক দিবস, বিএনসিসি দিবস, বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস পালন এবং  শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় আয়োজিত হয় বিভিন্ন সেমিনার, কর্মশালা ও সিম্পোজিয়াম। এছাড়াও পিকনিক, ডিপার্টমেন্টাল ট্যুর, চড়ুইভাতি আয়োজন, বিদায় অনুষ্ঠান, শীতকালে বারবিকিউ আয়োজন, অন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ইনডোর গেমসের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নিয়মিত ক্লাস, পরীক্ষা, ল্যাব, সেমিনার, কর্মশালার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সম্পন্ন করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে এখানকার শিক্ষার্থীরা। উচ্চতর গবেষণার মাধ্যমে মাস্টার্স, পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনে  ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, চীন, জাপান, আমেরিকা, ইউরোপ, তুরস্কের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে  প্রতিবছর স্কলারশিপ পায় এখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

এছাড়াও ব্যাংক, সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিসিএস, বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পায় এখানকার শিক্ষার্থীরা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের গবেষণা প্রতিবছর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। প্রতিবছর এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পায় এখানকার শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ২টি সমাবর্তনে চ্যান্সেলর ও ভাইস চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক পেয়েছে এখানকার শিক্ষার্থীরা।

পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের জন্য রয়েছে   বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন যেমন নোবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতি, বিএনসিসি, রোভার স্কাউট, নোবিপ্রবি ডিবেটিং সোসাইটি, কনজুমার্স ইয়ুথ বাংলাদেশ, মডেল ইউনাইটেড নেশন্স, বিজনেস ক্লাব, ফটোগ্রাফি ক্লাব, ইকো ক্লাব, সিএসটিই ক্লাব, লুমিনারি, পাঠশালা, সমকাল সুহৃদ সমাবেশ, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, শব্দকুটির, অভিযাত্রিক ব্লাড ব্যাংক, এনএসটিইউ ব্লাড ডোনার সোসাইটি, নোবিপ্রবি থিয়েটার, ধ্রুপদ, অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব ইত্যাদি।

ভৌত স্থাপনার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বার সংলগ্ন ফাউন্টেন পেন আকৃতির শহিদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য, বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল, উপাচার্য ভবন, অডিটোরিয়াম উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি একটি প্রশাসনিক ভবন, দুটি একাডেমিক ভবন, চারটি  আবাসিক হল, একটি লাইব্রেরী, একটি অতিথিশালা, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ডরমেটরি, কেন্দ্রীয় মসজিদ, আইসিটি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি মোবাইল অ্যাপস অ্যান্ড গেইম ডেভেলপমেন্ট ল্যাব এবং একটি নেটওয়ার্কিং ল্যাব, বৈদ্যুতিক লাইনসহ ১ হাজার কেবিএ বৈদ্যুতিক সাব স্টেশন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ও রিভার্স অসমোসিস প্ল্যান্ট,  ৩শ’ লাইন বিশিষ্ট বিটিসিএলের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও ৫শ’ লাইন ক্ষমতা বিশিষ্ট পিএবিএক্স এক্সচেঞ্জ, শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বাস, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সিভিলিয়ান বাস ও মাইক্রোবাস, নোবিপ্রবি পরিবারের সব শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে পুকুরের সৌন্দর্য বর্ধনে চারপাশে বৃক্ষরোপণ, দৃষ্টিনন্দন ওয়াকওয়ে নির্মাণ এবং চারপাশ বর্ণিল আলোয় সজ্জিত করা হয়েছে।

বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহের মধ্যে  ১০ তলা বিশিষ্ট একাডেমিক ভবন নির্মাণ, ১০ তলা বিশিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তা টাওয়ার, হাউস টিউটর, স্টাফ কোয়ার্টার ও প্রভোস্ট টাওয়ার নির্মাণ, মেডিক্যাল সেন্টার ও  কেন্দ্রীয় মসজিদ নির্মাণ, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের  উপাসনালয় নির্মাণ, বিএনসিসি ও রোভার স্কাউট ভবন নির্মাণ কাজ চলমান আছে। ভবিষ্যৎ প্রকল্পসমূহের মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অদূরে অবস্থিত উপকূলের ৭৭৮ একর জমির উপর ‘দেশরত্ন শেখ হাসিনা সমুদ্র বিজ্ঞান ও সমুদ্র সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট। যেখানে ডেলটা ফরমেশন, সমুদ্র বিজ্ঞান, ইকো ট্যুরিজম, ম্যানগ্রোভ বনসহ বিভিন্ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণা সম্ভব হবে।

এছাড়া কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা, মহাকাশ গবেষণা, মেটারিয়াল সায়েন্স, রোবটিক্স, ন্যানো টেকনোলজি বিষয়ে বিশ্বমানের গবেষণাগার নির্মাণ ও আইসিটি মন্ত্রাণালয়ের অর্থায়নে নিকট ভবিষ্যতে বিজনেস ইনকিউবেটর সমৃদ্ধ পূর্ণাঙ্গ হাইটেক পার্ক করা হবে।

আয়তন ছোট হলেও এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কমতি নেই। শহীদ মিনার থেকে অডিটোরিয়াম, একাডেমিক ভবন থেকে লাইব্রেরি ভবন, খেলার মাঠ থেকে হল, নীলদিঘি থেকে গোলচত্বর, বকুলতলা, লন্ডনরোড, কাপলরোড, হতাশার মোড় সব মিলিয়ে নোবিপ্রবি আমাদের  ভালোবাসার ক্যাম্পাস।

ষড়ঋতুর পালাবদল হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায় নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসে। গ্রীষ্মের আগমনে কালো মেঘে ছেয়ে যায় পুরো ক্যাম্পাস, শুরু হয় কালবৈশাখী ঝড়, প্রকৃতি হয়ে ওঠে রুক্ষ। আবার বর্ষার আগমনে প্রকৃতি হয়ে উঠে সতেজ।  শরতের কাশফুল যেন হেমন্তে এসেও তার ভালোবাসার জানান দেয়, বাতাসে দোলানো কাশফুল দেখলে মনে হয় এ যেন সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে।

এছাড়া  সূর্যমুখী ফুলের আগমনেও নোবিপ্রবি পায়  নতুন সাজ। শীতের সময় অতিথি পাখির আগমন ক্যাম্পাসকে আরো পরিপূর্ণ করে তোলে। বিবি খাদিজা হল সংলগ্ন লেকে এবং সেন্ট্রাল লাইব্রেরি সংলগ্ন পুকুরে চোখে পড়ে অতিথি পাখির কিচিরমিচির কলতান, যা  দেখতে ভিড় জমায় আশেপাশের অনেক দর্শনার্থী। পাখির কলতানে সবসময় মুখরিত থাকে পার্ক ক্যান্টিন। ক্লাসের ফাকে, ছুটির দিনে আড্ডায়, গানে, গল্পে মুখরিত থাকে ক্যাম্পাস। দু’পাশে সারি সারি ঝাউগাছে মোড়ানো বিশ্ববিদ্যায়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ধারক লন্ডন রোডটি ভিসির বাসভবনের দেয়াল ঘেঁষে গেস্টহাউজ ও  শিক্ষক ডরমিটরিকে হাতের বামে রেখে আঁকাবাঁকা পথে রাস্তাটি গিয়ে মিলেছে শিক্ষার্থীদের মিলন মেলা নীলদিঘির পাড়ে। চারপাশের সারি সারি নারিকেল গাছ এর সৌন্দর্যকে যেন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই দিঘির পাড়েই প্রতিদিন বোনা হয় হাজারো রঙিন স্বপ্ন, ভেঙ্গে যায় অনেক মধুর সম্পর্ক। ভাঙা-গড়ার এই মিলনমেলায় মুখর হয়ে উঠে বিকেল। ১০১ একরের এই স্বপ্নভূমি দিনের আলোয় যেমন শিক্ষার্থীদের পদচারণায় থাকে জাগ্রত, ঠিক তেমনি রাতের আঁধারে আবির্ভূত হয় নতুন রূপে। সোডিয়াম  বাতির আলোয় আলোকিত হয় সমস্ত ক্যাম্পাস। ফাউন্টেন পেন খ্যাত শহীদ মিনার থেকে শুরু করে একাডেমি ভবন, প্রশাসনিক ভবন, পার্ক কিংবা বিশাল নীল দিঘি নতুন রূপে প্রজ্জ্বলিত হয়। সারা দিন যেখানে শিক্ষার্থীদের ভিড় থাকে, রাতে সেখানে বিরাজ করে নিস্তব্ধতা।

দৃষ্টি নান্দনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে নোয়াখালীর অন্যতম দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি) অন্যতম। নোবিপ্রবির এই ১০১ একরের ক্যাম্পাস যেন প্রকৃতি আর মানব প্রাণের মিলনস্থল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিময় দিনগুলোর সাক্ষী হয়ে থাকে এই ক্যাম্পাস। অপরুপ সৌন্দর্যের নোবিপ্রবির ১০১ একরের ক্যাম্পাস আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার।

লেখক: শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

নোবিপ্রবি/মাহি