ক্যাম্পাস

ছোট্ট আইমানের বড় কীর্তি!

আইমান আল আনাম। মাত্র ক’দিন আগেই পা দিয়েছে ১০ বছরে। বর্তমানে চট্টগ্রামের সাউথপয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে সে। সম্প্রতি সে যোগাযোগের নতুন একটি অ্যাপলিকেশন (অ্যাপ) তৈরি করে সবাইকে চমকে দিয়েছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সেই খবর পৌঁছে গেছে বহির্বিশ্বেও।

মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ‘আরব নিউজ’ তাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে গত ২০ জানুয়ারি। এছাড়াও আরব নিউজের সূত্রধরে আইমানকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে বিখ্যাত নিউজ পোর্টাল MSN.COM। তার সাথে কথা বলেছেন চট্টগ্রামের পোর্টসিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আরাফাত বিন হাসান।

আরাফাত: অ্যাপস তৈরির আইডিয়াটা কীভাবে মাথায় এলো?

আইমান: প্রায় বছর দুয়েক আগের কথা, আমি অনলাইনের মাধ্যমে জানতে পারি ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সবকটা জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আবিষ্কারক বিদেশিরা। বাবার কাছে জিজ্ঞেস করে বিষয়টা আরো নিশ্চিত হই। তখন আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মনে হলো, বাংলাদেশের কেউ যদি এমন একটা অ্যাপলিকেশন (অ্যাপ) তৈরি করতে পারতো, যেটা কিনা চারদিকে সাড়া ফেলে দেবে, তবে কতই না ভালো হতো। তখন আমার মনে হলো আমি নিজে এমন একটা অ্যাপ্লিকেশন তৈরির চেষ্টা করলে কেমন হয়! একসময় একটা টিউটোরিয়ালে অ্যানড্রয়েড স্টুডিওর ব্যাপারে জানতে পারি। পরে ওটার মাধ্যমেই অ্যাপসটা তৈরি করি। গত বছরের মার্চের শেষের দিকে নেমে পড়ি অ্যাপ তৈরির কাজে। শুরুতে পড়ালেখার চাপের জন্য খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলাম না। পরে বার্ষিক পরীক্ষার পর পুরো সময়টা ব্যয় করি অ্যাপ তৈরির কাজে। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর পুরোপুরিভাবে শেষ হয় অ্যাপ তৈরির কাজ। এই কাজে আমাকে সহযোগিতা করেছে ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিও টিউটোরিয়াল এবং ইন্টারনেটের বিভিন্ন তথ্য।

আরাফাত: গুগলের অনুমোদন কীভাবে পেলে?

আইমান: অ্যাপ তৈরির পর সেটা কীভাবে সবার কাছে পৌছানো যাবে সেটা নিয়েও চিন্তা করছিলাম তখন। সহজে উত্তরও পেয়ে গেলাম। গুগল প্লে স্টোর! কিন্তু গুগলে সেই অ্যাপ পাঠাবো কী করে? কিংবা গুগলে পাঠালেই কি তারা অনুমোদন দিয়ে দেবে? এসব প্রশ্নের উত্তর বের করার জন্য সাহায্য নেই অনলাইনের। ধীরে ধীরে সবগুলো প্রশ্নের সমাধান বের করি। গতবছরের ২৭ ডিসেম্বর অ্যাপ তৈরির কাজ শেষ হলে সেটা পাঠিয়ে দিই গুগল কর্তৃপক্ষের কাছে। গুগল কর্তৃপক্ষ সবকিছু যাচাই-বাছাই করে গত ৩১ ডিসেম্বর মেইল করে। প্রথম মেইলে গুগল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদনের খবরটা না থাকায় কিছুটা হতাশ হয়ে যাই। তবে মেইলটার নিচে লেখা থাকে ‘নিউ ইনফরমেশনস আর অ্যাভেইলেবল’। সেখানে ক্লিক করতেই চোখের সামনে ভেসে আসে গুগলের অভিনন্দন বার্তা। সেসময় সংবাদটি দেখে বেশ কিছুক্ষণ ফোনটা বুকের সাথে জড়িয়ে রাখি। এরপর মা-বাবাকে জানালে তারাও আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণ অভিনন্দন জানায়।

আরাফাত: মায়ের নামে অ্যাপের নাম রাখার কারণ?

আইমান: আমরা দুই ভাইবোনের মধ্যে বড় আমি। বাবা তো বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে, তাই বলতে গেলে মা সবসময় আগলে রাখে আমাদের। তাই হয়তো মায়ের প্রতি ভালোবাসাটা একটু বেশিই। তাই অ্যাপটার নাম রাখা হলো মায়ের নামে। গুগল কর্তৃপক্ষ আমার নির্ধারিত ‘লিটা ফ্রি ভিডিও কলস অ্যান্ড চ্যাট’ নামেই গুগল প্লে স্টোরে আপলোড করেছে অ্যাপটি। বর্তমানে ‘লিটা ফ্রি ভিডিও কলস অ্যান্ড চ্যাট’ নামে গুগল প্লে-স্টোরে পাওয়া যাচ্ছে এটি। তবে বাবাকেও কিন্তু সমান ভালোবাসি। তাই পরবর্তী সময়ে কোনো অ্যাপ বানালে সেটার নাম রাখা হবে বাবার নামে। আর আপনাকে বলে রাখি, গুগল প্লে-স্টোরে অ্যাপটির বর্ণনায় ‘অ্যাপ ক্রিয়েটেড বাই আইমান আল আনাম’ লেখা আছে।

আরাফাত: ইমো-হোয়াটসঅ্যাপের চেয়ে এটার বিশেষ কোনো তফাৎ আছে?

আইমান: বর্তমানে ভিডিও ও অডিও কলের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাপলিকেশন (অ্যাপ) ইমো-হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ভিডিও কলে কথা বলার সময় কিন্তু ছবির মান খুব একটা ভালো থাকে না। ইন্টারনেট সংযোগ দুর্বল হলে তো কলই কানেক্ট হয় না এসব অ্যাপের মাধ্যমে। কিন্তু ‘লিটা ফ্রি ভিডিও কলস অ্যান্ড চ্যাট’ এর মাধ্যমে ভিডিও কলে কথা বলার সময় ভিডিও চিত্র থাকবে স্পষ্ট, এইচডি (হাইডেফিনেশন)। আর এই অ্যাপটি দুর্বল নেটওয়ার্কেও স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে। এছাড়াও ‘লিটা ফ্রি ভিডিও কলস অ্যান্ড চ্যাট’ অ্যাপের মাধ্যমে যেকোনো মাপের ফাইল পাঠানো যায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। ব্যবহারকারীদের সুবিধার্থে অ্যাপটি নিয়মিত আপডেট করা হবে। আর আপনি যেনে খুশি হবেন ইতোমধ্যে গুগল প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপটি প্রায় ৩০ হাজার ব্যবহারকারী ডাউনলোড করেছে।

আরাফাত:  এখন তারকা খ্যাতির জন্য বাইরে গেলে সমস্যায় পড়তে হয়?

আইমান: আসলে অ্যাপটি তৈরির কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় বাইরে কোথাও বেরুলে এখন মধুর এক সমস্যায় পড়তে হয়। দেখা মাত্রই সবাই চিনে ফেলে, আবদার করে সাথে একটা সেলফি নেয়ার। আবার অ্যাপ তৈরির কথা স্কুলে জানাজানি হলে সেখানেও হুলস্থুল পড়ে যায়। স্কুলে তো বন্ধু থেকে শুরু করে অন্য শিক্ষার্থী, অভিভাবক কিংবা শিক্ষক সবাই খুশি।

আরাফাত: আচ্ছা, কম্পিউটার ছাড়া আর কি কি ভালো লাগে?

আইমান: কম্পিউটার কিংবা প্রোগ্রামিং আমার সমস্ত ধ্যান-জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু তা ঠিক। তবে, পাশাপাশি ক্রিকেট প্রীতিও কিন্তু আছে আমার। সময় সু্যোগ পেলে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট মাঠে ব্যাট বল নিয়ে নেমে পড়ি। আমার প্রিয় ক্রিকেটার পৃথিবীর এক নম্বর অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে যেহেতু দৌড়ানোটাও ভালোই করা হয়, তাই সেদিকটাও কিছুটা উন্নত হয়েছে মেবি। গতবছর স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দৌড় প্রতিযোগিতাতে জুনিয়র ক্যাটাগরিতে প্রথম হয়েছিলাম আমি।

আরাফাত: তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

আইমান: পড়ালেখার পাশাপাশি ভবিষ্যতে আরো কিছু অ্যাপ তৈরি করতে চাই, যা কিনা কোনো না কোনোভাবে মানুষের উপকারে আসবে। একদম ছোট থেকে কম্পিউটারে ডুবে থাকার সময় বাবা-মায়ের সজাগ দৃষ্টি থাকলেও আমাকে কখনো বাধা দেয়নি তারা। আমার ইচ্ছাকেই তারা প্রাধান্য দেয়। বড় হয়ে একজন আইটি বিশেষজ্ঞ হতে চাই। মানে স্বপ্ন একজন সফল সফটওয়্যার প্রকৌশলী হবো। কোডিং আর খেলাধুলার পাশাপাশি আমার কিন্তু ছোট্ট একটা শখও আছে। আর সেটা হলো বাগান করা। বাসার বেলকনিতে ছোটখাটো একটা বাগানও আছে আমার। ভবিষ্যতে এই বাগানটার পরিসর বাড়াতে চাই।

আরাফাত: ধন্যবাদ তোমাকে।

আইমান: আপনাকে এবং রাইজিংবিডিকে অনেক ধন্যবাদ।

 

চট্টগ্রাম/হাকিম মাহি