ক্যাম্পাস

এরা ক্যাম্পাসের পলান সরকার

আপনি বই পড়তে ভালোবাসেন? সারা দিন বইয়ের রাজ্যে ডুব দিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে? নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, হুমায়ূন থেকে শুরু করে হালের জনপ্রিয় সব লেখকের লেখা গোগ্রাসে গিলবেন এমন সুপ্ত বাসনা দীর্ঘদিন ধরেই মনে চেপে বসে আছেন। কিন্তু সমস্যা একটাই! কোথায় পাবো এত বই? এত টাকা কই বই কেনার?

বাড়ি থেকে যে টাকা আসে, তা একাডেমিক পড়াশোনার খরচ দিতে শেষ! চিন্তা নেই, আপনার জন্যই একদল তরুণ অধীর আগ্রহে বসে আছেন। তারা চান আপনি আপনার সুপ্ত বাসনা পূরণ করুন কোনো খরচ ছাড়াই। কিন্তু শর্ত একটাই, বই পড়ে আবার ফেরত দিতে হবে। এই শর্তে রাজি হলে আপনি পেয়ে যাচ্ছেন আপনার পছন্দের সব বই ফ্রিতেই!

বলছিলাম কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বইয়ের ফেরিওয়ালা’র কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়জন শিক্ষার্থী মিলে গড়ে তুলেছেন এক ব্যতিক্রমধর্মী সংগঠন। নাম তার ‘বইয়ের ফেরিওয়ালা’। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বই পড়ানোর কার্যক্রম এটি। একে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারও বলা যায়। যেখানে বইপ্রেমীরা বিনামূল্যে ও বিনাশর্তে বই নিয়ে পড়তে পারেন। কোনো জামানত নেই, চাঁদা নেই, সদস্যও হতে হয় না। বই ফেরতের তারিখও পাঠক ঠিক করেন। কোনো সময়ও বেধে দেয়া হয় না।

শুধু বই নিয়ে পড়বেন তা কিন্তু নয়। কেউ চাইলে এখানে বইদান কিংবা অন্য পাঠকদের পড়ার জন্য বই ধার দিতেও পারেন।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে ২০১৮ সালের এপ্রিলে। উদ্দেশ্য একটাই, তরুণ প্রজন্মকে বই পড়ায় উৎসাহিত করা। চারদিকে যে মূল্যবোধের অবক্ষয়, মাদকের ছোবল, সমাজের প্রতি যে দায়িত্বহীনতা; তা থেকে তরুণ সমাজকে রক্ষা করা। তাঁরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে খুলেছেন একটি গ্রুপ। সেখানে বইয়ের তালিকা দেয়া হয়। সেই তালিকা থেকে যার, যে বই পছন্দ, সেটা কমেন্ট করলেই নিজ দায়িত্বে পৌঁছে দেন পাঠকের হাতে। এটাই শেষ নয়। পাঠকের পড়া শেষ হলে আবার সেটা ফেরত নেন নিজ দায়িত্বে।

ইদানীং ক্যাম্পাসে বই নিয়ে বসে থাকেন সংগঠনটির সদস্যরা। প্রায়ই দেখা যায়, দুই তিনজন বই নিয়ে বসে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠাল তলায়। সেখান থেকে পাঠকরা বই নিচ্ছেন তাদের পছন্দ অনুযায়ী । দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন এরাই ক্যাম্পাসের ‘পলান সরকার’।

সংগঠনটির  অন্যতম উদ্যোক্তা লোক প্রশাসন বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী মারুফ বলেন, ‘বই চিত্তকে বিনোদিত করে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে বইয়ের ভূমিকা ব্যাপক। কিন্তু এখনকার তরুণদের মুঠোফোন আসক্তি প্রবল। আমাদের মনে হয়েছে এ থেকে উত্তরণে বই হতে পারে দারুণ সমাধান।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা চাই বাংলাদেশের প্রত্যেকটি ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে বই পৌঁছে দিতে। রাষ্ট্রের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে। প্রত্যেককে জ্ঞানচর্চায় আগ্রহী করে তুলতে চাই আমরা। মেধা ও মননে অগ্রগণ্য পাঠক সমাজ গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে বইয়ের ফেরিওয়ালা।’

সংগঠনটির আরেক উদ্যোক্তা লোক প্রশাসন বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী আনিকা তাসনিম সুপ্তি বলেন, ‘বইয়ের ফেরিওয়ালাতে বিনামূল্য ও বিনাশর্তে বই পড়তে দেয়া ছাড়াও উপন্যাসপাঠ, গল্পপাঠ, প্রবন্ধ পাঠ, কবিতা আবৃত্তি, ছড়াপাঠ, বিভিন্ন মনীষীদের আত্মজীবনীপাঠ, সাহিত্যিক পরিচিতিপাঠ এবং বইয়ের রিভিউ করা হয়ে থাকে।’

পাঠককে যে বই পড়ান, তার উৎস কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফেরিওয়ালার সদস্যরা মূলত তাদের নিজস্ব সংগ্রহের বই দিয়ে বই পড়ানোর কাজটি পরিচালনা করেন। তাছাড়াও সদস্যদের বাইরেও কোনো ব্যক্তি যদি বই দিয়ে সহযোগিতা করতে চায়, সেই ব্যবস্থাও আছে।’

কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মৃন্ময় সোহাগ বলেন, ‘কার্যক্রম চালাতে গিয়ে একটি বুথের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। কারণ বই দেয়া আর নেয়াতে নির্দিষ্ট জায়গা না থাকায় আমরা সমস্যার সম্মুখীন হই এবং বই নিয়ে বসার মতো কোনো জায়গা পাই না। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি একটি বুথের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে কাজটা আরেকটু সহজ হতো।’

বইয়ের ফেরিওয়ালা থেকে বই নিয়ে পড়ছেন অনেকেই। অনেকের তৈরি হয়েছে পড়ার অভ্যাস। এমনই একজন হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী সানজিদা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বই পড়ার জন্য কোনো রকম রেজিস্ট্রেশন করতে হয় না এবং কোনো কার্ড করতে হয় না। তাই আমরা খুব সহজেই কোনো রকম ঝামেলা ছাড়া বই সংগ্রহ করতে পারি।’

আরেকজন নিয়মিত পাঠক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া শারমিন এনি। তিনি বলেন, ‘বইয়ের ফেরিওয়ালা বই পড়ুয়াদের জন্য অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো। বইয়ের ফেরিওয়ালা বই না পড়ুয়াদের জন্যেও এমন এমন বই সংগ্রহে রাখেন, যাতে তারা বই পড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাছাড়া তাদের থেকে বই নিয়ে পড়তে গিয়ে পোহাতে হয় না কোনো ঝামেলা।’

উল্লেখ্য, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বইয়ের ফেরিওয়ালার কার্যক্রম চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় ২০১৫ সালে। এরই অংশ হিসেবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছেন মারুফ, সুপ্তি ও সোহাগরা। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সদস্য হওয়ার ঝামেলা ছাড়া এবং কোনোপ্রকার ফি দেয়া ছাড়াই তাদের চাহিদামতো বই পেয়ে থাকে।

এছাড়াও বইপাঠ প্রতিযোগিতা, চিঠি উৎসব, বুক রিভিউ এবং পাঠচক্রের আয়োজন করে থাকে সংগঠনটি। তাছাড়া ‘ইউটিউব’-এ বইপাঠে আগ্রহী করতে ‘বইয়ের ফেরিওয়ালা’ নামে একটি চ্যানেল আছে। চ্যানেলে বুক রিভিউ, গল্পপাঠ, কবিতা, উপন্যাসপাঠসহ নানা শিক্ষামূলক কার্যক্রম প্রচারিত হয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। কুবি/হাকিম মাহি