ক্যাম্পাস

বকপক্ষীর মুক্তির আয়োজন

মানুষের দৌড়ঝাঁপ দেখে মনে হয় সে এক বকপক্ষী। বকের উড়ে চলার মতো করে এই মানুষের ছুটে চলা। লক্ষ্যের দিকে তাদের অব্যর্থ দৃষ্টি, যেন বকের মতো তীক্ষ্ণ নজর শিকারের দিকে, এ সবকিছু থেমে গেছে এই ক’দিনে। হোম কোয়ারেন্টাইনের এ সময়টায় বক-মানুষ আজ খাঁচায় বন্দি। ফন্দি আঁটছে কীভাবে পাওয়া যায় মুক্তি। বক-মানুষের এক দিবস মুক্তির আয়োজন করতেই আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো আরেক বকপক্ষীর সাথে।

হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’ দেখা শেষ হলো। কোনো বিশাল আয়োজন নেই। আয়োজন বলতে এতটুকু, ধারাবাহিকটির কেন্দ্রে আছেন হুমায়ূন আহমেদ।

যতক্ষণ আপনি নাটকটা দেখতে থাকবেন, মনে হবে খাঁচায় আগলে রেখেছেন এক বকপক্ষীকে, নাটক শেষ হতেই মনে হবে বকপক্ষী উড়ে গেছে। শুধু মনের কোনো এক কোণে রেখে গেছে তার একটা পালক। এই পালক এ নাটকের উদ্ভট মানুষগুলো, এ পালক নাটকের প্রতিটা মহামুহূর্ত, এ পালক নাটকের প্রতিটা সংলাপ, কমেডি- যা কিনা কিছুক্ষণের জন্যও মাথার ভেতর থেকে আড়াল করা যায় না।

বেঁচে থাকতে হুমায়ূন আহমেদের Name, Fame, Glory কোনো কিছুরই কমতি ছিলো না। জীবনে কী পেয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ? এ প্রশ্ন না করে যদি বলা হয়, কী পাননি হুমায়ূন আহমেদ? তাহলে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া খুব শক্ত। তবে, হুমায়ূনের চলে যাওয়ার পরেও মানুষগুলো যে তাকে ভালোবাসে, তার সৃষ্টিকর্মের জন্য, সেসবের প্রত্যক্ষ পাওয়া তাঁর হয়ে ওঠেনি।

একটা সহজ উক্তি, সহজ বর্ণনায় সব বৃত্তের পরিধিকে তিনি কেন্দ্রে সংকোচিত করে নিয়ে আসেন। ঠিক কতজন পারে এমন?

সাহিত্যের মানদণ্ডে তাঁর সাহিত্য কী, কেমন? অন্য মহৎ সাহিত্যের সাথে তাঁর রচনার তুলনা করলে তা শুধু বাষ্পে পরিণত হবে। মিলিয়ে যাবে অসীম শূন্যতায়। কিন্তু আবার এ বাষ্পকে জমা করা যায়, পরিণত করা যায় মেরু অঞ্চলের বরফে, দুর্গম, অলঙ্ঘনীয়- যেখানে অন্য সাহিত্যিকরা পৌঁছুতে পারেন না। পৌঁছানো সম্ভবও নয়। তাঁর অন্য সব সৃষ্টিকর্মের বেলায়ও এরকমটা বলা যায়। ভাঁড়ামি নেই। হাসির উচ্ছ্বাস ছড়াবে না ঠিকই, কিন্তু মুখ থেকে হাসির রেখা মিলিয়ে ফেলা দায়, মুছে ফেলা অসম্ভব।

হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি প্রবণতা উদ্ভট চরিত্র নির্মাণের দিকে। তা তার সৃষ্ট নাট্যকর্ম বলি, আর সাহিত্য বলি, সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এরা আপাত উদ্ভট, আবার উদ্ভটও নয়। এর আমাদের কেউ। এই চরিত্রগুলো স্বয়ং আমরা।

তিনি কিছু চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, কলমের খোঁচায়, আর কিছু ক্যামেরার সঞ্চালনে। সব অনবদ্য, অনবদ্য না হয়ে পারে না এসব।

মেহের আফরোজ শাওন, রিয়াজ, চ্যালেঞ্জার, মাসুম আজিজ, ফারুক আহমেদ, স্বাধীন খসরু, এজাজুল ইসলাম, ড. ইনামুল হক- এরা হুমায়ূন আহমেদের মানুষ, এরা আমাদের মানুষ। আবার এরা আমাদের নন, এরা ভিন্ন গ্রহের, ভিন্ন আবাসনের, ভিন্ন রূপের, ভিন্ন জগতের, নাটকের, নাটকের ভেতরের।

আমরা কাহিনি বলতে আসিনি। বলতে আসিনি গল্পের পটভূমি। ‘স্পয়লার আ্যালার্ট’ বলে কিছু আছে। আমরা শুধু আগ্রহ জাগাতে এসেছি। ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’ আপনাদের হয়তো নিয়ে যাবে কোনো ভিন্ন জগতে, যেখানে হাসির ফোয়ারায় প্লাবন হয় না, আবার যেখানে ভরা নদী কখনো শুকিয়ে যায় না।

দেখতে দেখতে সিরিয়ালটা শেষ হয়ে গেছে! কী এক শূন্যতা কাজ করছে, তা ভাষায় বোঝানো যাবে না। তৈয়ব, ফজলু, বৈদেশি, পুষ্প, ওস্তাদ জালাল খাঁ ওরা যেন আমার চেনা জগত থেকে হারিয়ে গেলো, মুছে গেলো। তবুও যেন রেখে গেলো তাদের ছায়া, মহা মায়া, উড়ে যাওয়া বকপক্ষীর পালক।

নাটকের কিছু দার্শনিক সত্যও আপনাকে নাড়া দিয়ে যাবে। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে আমরা প্রত্যেকটা মানুষ বাস্তবে অভিনেতা। আমাদের পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে অফিসের প্রধান কর্তার সামনে পর্যন্ত সব জায়গায় চলছে আমাদের অভিনয়। তবুও কত বাঁধা। সব কিছুর মাঝে যেন কাঁটাতার। চাইলেই করা যায় না ইচ্ছেমাফিক কাজ, পূরণ করা যায় না মনের বেখেয়ালি ইচ্ছাগুলো।

এ সবকিছু থেকে উত্তরণের একটা সহজ সমাধান দিয়ে গেলেন ‘দোতারা চাচা’ (চ্যালেঞ্জার), ‘পাগলের ভাব ধইরা থাকনের মইদ্যে অনেক সুবিদা। যা খুশি করন যায়, যা খুশি বলা যায়, কেউ ঘাটায় না।’

‘টাকা পয়সা আমার কাছে কোনো বিষয় না, তেজপাতা, এই নেন ১০০ টাকা।’ ওস্তাদ জালাল খাঁর (রিয়াজ) মতো কেউ এসে হয়তো আপনাকে এ নাটক দেখার জন্য কোনো টাকা দিবে না, কিন্তু যতটা আনন্দ পাবেন, তা হয়তো বাংলা ছোটপর্দার অন্য কোথাও, কোনো নাটকে পাবেন না৷

একটুও বাড়িয়ে বলা হয়নি। এ কথার সত্যতা পাওয়া যাবে আপনি নাটকটা শেষ করার পর, বকপক্ষীকে আকাশে উড়ানোর পর, যখন থাকবে শুধু বকপক্ষীর পালক, আপনার আকাঙ্ক্ষা, ‘নাটকটা যদি শেষ না হতো!’

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, অষ্টম আবর্তন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। 

 

কুবি/হাকিম মাহি