ক্যাম্পাস

ইমু-তনুর কি মিলন হয়েছিল?

প্রত্যেকটি মানুষের মনেই বিপরীত লিঙ্গের কোনো একজন মানুষের প্রতি বিশেষ একটা আকর্ষণ থাকে। আর এই আকর্ষণটিই হচ্ছে ভালোবাসা। যে ভালোবাসা বোঝে না জাতপাত, ধনী-গরীব, উঁচু কিম্বা নিচু।

একজনের উপর আরেক জনের ভালোবাসা সৃষ্টির মূল কারণটা হয়তো বা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না। দুটি মনের মিলনে নাকি ভালোবাসার সৃষ্টি হয়, এ নাকি আত্মার মিলন। তাই কোনো কিছু হিসাব, বিবেচনা করে প্রেম-ভালোবাসা হয় না। অনেক সময় বুকে চেপে রাখা কথাগুলো দুঃখ হয়ে বেরিয়ে আসে মুখ দিয়ে। এমনই এক ভালোবাসা শুরু হয়েছিল ইমু আর তনুর মধ্যে।

ঘটনাস্থল নওয়াপাড়া যশোর। গল্পের শুরুটা হয়েছিল প্রায় ৯ বছর আগে। ছেলেটির নাম ইমতিয়াজ (রূপক) আর মেয়েটি তনুশ্রী (রূপক)। নওয়াপাড়ার মূল শহরেই তাদের বাড়ি। রাস্তার দুইপাশে মুখোমুখি দুজনের বাড়ি। উভয় পরিবারের সদস্যরা শিক্ষিত এবং এলাকায় ভালো গণ্যমান্য। ইমতিয়াজ মুসলিম পরিবারের।  দাদা-দাদী ও দুই চাচাসহ একসঙ্গে থাকেন। অন্যদিকে তনুশ্রী সনাতন পরিবারের। মা-বাবা, দুই ভাইবোন আর ঠাকুমাকে নিয়েই তাদের সংসার। তনুশ্রী ইমতিয়াজের তিন মাসের ছোট, সেই শৈশব থেকে একই সঙ্গে বেড়ে ওঠেছিল ওরা দুইজন। পড়ালেখায় দুজনই খুব ভালো ছিল, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে তারা দুজনেই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে, এসএসসিতেও দুজনই বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিল। দুজনের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়াটা ছিল চমৎকার। একে অন্যের সব থেকে ভালো বন্ধু ছিল তারা। তাদের মধ্যে কি আসলে বন্ধুত্ব? নাকি ভালোবাসা সেটা তারা নিজেরা কখনো অনুভব করেনি।

ইমতিয়াজ দেখতে সুদর্শন, শরীর সুগঠিত। অন্যদিকে তনুশ্রী যাকে ওর ঠাকুমা বলতো দেবী দুর্গা। এর কারণ হলো তনুশ্রীর চোখ ছিল আয়তলোচনাকার আর চুল কোকরানো, গায়ের রঙ দুধের মতো, এজন্যই ওর ঠাকুমা এই কথা বলতো। ইমতিয়াজকে তনুশ্রী ইমু বলে আর তনুশ্রীকে ইমতিয়াজ তনু বলে ডাকত। তারা যে একে অন্যকে ভালোবাসে তা প্রথম অনুভব করে কলেজ জীবনে।

হঠাৎ একদিন বিকেলে তনু মন খারাপ করে বসে আছে ওদের বাড়ির বেলকনিতে, ইমু কোনো এক কারণে গিয়ে দেখে তনু মুখ ভার করে বসে আছে। ইমু জানতে চাইলে তনুশ্রী বলে, তেমন কিছু না এমনি মন খারাপ। ইমু জানে, তনু মিথ্যা বলছে। একটু জোর করলে তনু বলে, তনুর বাবা ওর জন্য বিয়ে ঠিক করেছে। ছেলে পক্ষের পছন্দ হলে এনগেজমেন্ট করিয়ে রাখবে। শুনে ইমু ওর সঙ্গে অনেক মজা করেছিল। কিন্তু ওইদিন রাতে ইমু ঘুমানোর সময় হঠাৎ তনুর সঙ্গে কাটানো ছোটবেলার কথা মনে করে একা একা হাসতেছিল। হঠাৎ করেই কেমন জানি খারাপ লাগা শুরু হলো ইমুর।

ওইদিন সারারাত ঘুমায়নি ইমু। আর অন্য দিকে তনুর ও একই অবস্থা। পরের দিন সকাল সকাল ইমু তনুকে ফোন করে বলে আজ একটু তাড়াতাড়ি কলেজ যাবে। ওইদিন কলেজের জন্য দুইজনই বাসা থেকে বের হলো ঠিকই, কিন্তু প্রতিদিনের মতো ওরা একে- অন্যের পেছনে লাগল না। ওইদিন দুইজন কলেজে না গিয়ে একটি পার্কে গিয়ে বসেছিল। এমনিতে ওরা কখন চুপ করে বসে থাকার লোক নয়, দুইজন এক জায়গায় হলে কথার খৈ ফুটত। কিন্তু আজ দুইজনই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।  হয়ত বা দুজনই মনের মধ্যে থাকা কোনো কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু কে কীভাবে বলবে তা বুঝে উঠতে পারেনি। তাই না বলা কথাগুলো বুকে চেপে রেখেই ওইদিন ওরা বাসায় চলে যায়। ওইদিনের পর তনুর সঙ্গে ইমুর বেশ কয়েক দিন যোগাযোগ ছিল না।

একদিন তনুই ইমুর বাসায় দেখা করতে এলে ইমুর মা বলে, ওর জ্বর হইছে তুই জানিস না, সারা দিনতো একই সঙ্গে থাকিস। তনু বলল, জানবো কী করে? আপনার বাদর ছেলে ফোন বন্ধ করে রাখছে। ইমুর মা বলল, যা দেখ রুমে শুয়ে আছে, আর আমি আমের আচার বানিয়েছি খেয়ে যাস। হঠাৎ করে তনুকে দেখে ইমু মুখ ঘুরিয়ে নিল। বলল, তুই কী করছিস এখানে? তনু হাসতে হাসতে বলল, আন্টি বলল উপরের চিড়িয়াখানার বাদরের নাকি জ্বর হইছে, বাদরামি করতে পারছে না তাই দেখতে আসলাম।

ইমু রেগে গিয়ে বলল, বাদরের উপর এত ভালোবাসা দেখাতে হবে না, তুই যা। তনু বলল, কাল আমায় ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। ইমু বলল, আমি কী করব? কাল আটা-ময়দা মেখে সামনে যাস, এমনিতেই ভয়ে পালাবে। তনু হঠাৎ করে বলল, ‘তুই কিছুই বুঝবি না’ বলতে না বলতেই চলে গেলো।

পরদিন ইমুর মা ইমুকে বলছে, তনুকে দেখতে এসেছিল পাত্র পক্ষ। ওকে পছন্দ করেছে, আগামী মাসে এনগেজমেন্ট। ইমু চুপচাপ বসে কথাগুলো শুনল কিছুই বলল না। দুইদিন পর তনু ইমুকে বলল, বিকেলে খেয়াঘাটে দেখা করতে। আসলে মানুষ যখন বুঝতে পারে নিজের কাছের কিছু হারিয়ে যাচ্ছে, তখনই ওই জিনিসের উপর তার কতটা আবেগ জড়িয়ে আছে, সেটা মানুষ বুঝতে পারে। আর তনু ইমুর ক্ষেত্রে এই আবেগটি ছিল ভালোবাসা।

ওই দিন নদীর পাড়েই তারা দুইজন দুইজনকে প্রথম ভালোবাসি এই কথাটি বলেছিল। হয়তো বা দূরে হারিয়ে যাবার ভয়ই তাদের অনুধাবন করিয়েছিল যে, তারা দুজনেই মনের অজান্তে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে। মনের বন্ধনে তো ওরা আবদ্ধ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সবচেয়ে বড় বাঁধা এখনও তাদের সামনে দাঁড়িয়ে রইল, তা হলো ধর্ম। তারা দু’জনই খুব ভালো করেই জানত তাদের সম্পর্কটা কখনই পরিবারের লোকজন মেনে নেবে না।

তনুর এনগেজমেন্টের কিছু দিন আগে হঠাৎ ইমু আর তনুকে পাওয়া যাচ্ছে না। ইমু সকালে তনুকে নিয়ে ওর ছোট চাচার মোটরসাইকেলে করে বের হয়েছে। ওরা বাসায় বলেছে এক বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেলো কোনো খোঁজ নেই, মোবাইলও বন্ধ। চারদিকে সবাই খোঁজ করল কোনো বিপদ হলো নাকি। অবশেষে দুটো পরিবারের কাছে মোবাইলে একটি মেসেজ আসে, ‘আমরা একে অপরকে ভালোবাসি, জানি তোমরা আমাদের সম্পর্কটা মেনে নেবে না, তাই নিজেরাই তোমাদের ছাড়া বিয়ে করেছি, পারলে আমাদের ক্ষমা করে দিও।’ এখান থেকেই শুরু হলো ঝামেলা, এক পরিবার আর এক পরিবারের ছেলেমেয়েকে দোষারোপ করতে  শুরু করল। শুরু হল ওদেও খুঁজে বের করার কাজ।

ইমু-তনু পালিয়েছে কয়েক মাস হয়েছে।  ইমু-তনুকে নিয়ে পালিয়ে এসে তার দূর সম্পর্কের এক খালার বাসায় উঠেছিল। পালানোর সময় বাড়ি থেকে ১৫,০০০ টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল। টাকা প্রায় শেষের দিকে তাই খালার এলাকার এক প্রিন্ট ফটোকপি দোকানে কাজ শুরু করে ইমু। এক দিকে তনুর পরিবার ইমুর নামে মামলা করেছে, ইমুর পরিবারও পাল্টা মামলা করেছে। যে দুটি পরিবারের সকাল হতো একে অপরের মুখ দেখে, আজ একে অন্যকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয় ঘৃণায়।

প্রায় সাত মাস হয়ে গেলো তনু এদিকে অন্তঃসত্ত্বা। ওরা চিন্তা-ভাবনা করেছে তাদের বাচ্চা হওয়ার পরেই বাড়িতে ফিরবে।এর পরে যদি তাদের পরিবার তাদের মেনে নেয় তবে ভালো, আর তা না হলে নিজেরাই নিজেদের মতো চলবে। কিন্তু প্রায় ৮ মাস পর খুঁজতে খুঁজতে তাদের সন্ধান পায় ইমুর ছোট চাচা। পুলিশ আর পরিবারের লোকজন গিয়ে তাদের তুলে নিয়ে আসে। ইমু ও তনু এখন দুই বাড়িতে গৃহবন্দি অবস্থায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

 

যবিপ্রবি/হাকিম মাহি