ক্যাম্পাস

কলকাতার পথে প্রান্তরে

কলকাতা শব্দটা মাথায় আনতেই বর্তমানে অনুপম রায়ের কলকাতা গানের লাইনগুলো কানে ভাসে। সর্বশেষ কলকাতা গিয়েছিলাম বছর তিনেক আগে। এমন হুট করেই বলা যায় ঠিক করলাম কলকাতা ঘুরে আসি।

অসংখ্য প্রাসাদ, অট্টালিকা ও পুরনো স্থাপনার শহর কলকাতা। ইংরেজ শাসনামলের চিহ্ন এশিয়ার যে কয়টি হাতেগুণা শহর টিকে আছে, কলকাতা তার মধ্যে শীর্ষে। শহরের দক্ষিণের অংশে ব্রিটিশরা বাস করতো, যাকে বলা হতো হোয়াইট টাউন এবং উত্তর অংশে ভারতীয়রা বাস করতো, যাকে বলা হতো ব্ল্যাক টাউন। বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা কলকাতাকে ভারতের রাজধানী করে রেখেছিল।

কলকাতা নামের ইতিহাস বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। ব্রিটিশ শাসকরা এর নাম দিয়েছিল ক্যালকাটা - Calcutta। ভারত সরকার পুনরায় নাম বদলে করে কলকাতা।

কলকাতা শহর টোকিও ও কিয়োটোর পর এশিয়ার সবচেয়ে বেশি নোবেল বিজয়ী উপহার দিয়েছে। স্যার রোনাল্ড রস, সি ভি রমন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন এবং মাদার তেরেসা- এরা সবাই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

বাংলাদেশের মানুষকে কলকাতার বাঙালিরা আলাদা কদর করে। বয়সীরা এখনো ডাকে ‘জয় বাংলার লোক’ বলে। তাদের বিস্ময় কাটেনি যে মাছে-ভাতে বাঙালি যুদ্ধ করে নিজেদের জন্য গোটা দেশকেই স্বাধীন করে ফেলেছে।

কলকাতার রেলওয়ে সার্ভিস না দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন না আসলে সার্ভিস কীভাবে করতে হয়। বোঁনগাও থেকে শিয়ালদহ যেতে লাগে প্রায় তিনঘণ্টা। আমি শিয়ালদহর আগের স্টেশন উল্টডাঙ্গা বা বিধাননগর জংশনে নেমে গেলাম। বিধাননগরের পূর্ব নাম ছিল সল্টলেক বাংলাই লবণহ্রদ। পরে এটাকে বিধাননগর করা হয়েছে।

ট্রেন থেকে নেমে আন্ডারপাস ধরে রোডে উঠলাম। তখন বিকাল বিকাল ভাব চলে এসেছে। ঘড়িতে সাড়ে তিনটা। সিটি সেন্টারে আসলেই চোখে পড়লো একটি লাইফসাইজ মডেল, একটি ঘোড়া চালিত ট্রাম। কলকাতা জুড়ে এটি ঐতিহ্যবাহী গণপরিবহন। কলকাতা এসেছেন আর রাস্তায় ট্রাম দেখেননি, এটা এক প্রকার অসম্ভব।

মুকুন্দপুর যাওয়ার বাসে উঠতেই বিকালের নরম আলো মুখে এসে পড়লো। একদম পেছনের দিকে একটি সিটে গিয়ে বসে পড়লাম। জানালা দিয়ে ফুটপাতের দোকানগুলো দেখছি।

পরের দিন ধর্মতলা গেলাম। একদিক থেকে কলকাতার মূল পয়েন্ট এটিই। অনেক সকাল সকাল আসায় দোকানপাট তেমন খোলেনি এখনো। হালকা হালকা কুয়াশাচ্ছন চারদিক, সকালের আলো কেবল ফুটছে। কলকাতাতে আসলে আরেকটা জিনিস দারুণভাবে চোখে পড়বে সেটা হলো কাক। এদিক ওদিক সেদিক সবখানে।

প্রথমে গেলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালসসে। ভারতসম্রাজ্ঞী উপাধি প্রাপ্ত রানী ভিক্টোরিয়ার মূর্তিটি আগাগোড়া শ্বেত পাথরের তৈরি। এখানে একটা জাতীয় সংগ্রহশালাও আছে।

ধর্মতলাতে এসে সবার আগে যেটা চোখে পড়বে সেটা সেন্ট পলস। এটি একটি আ্যালিংক্যান ক্যাথিড্রাল। মূলত এটি গথিক স্থাপত্য। এশিয়ার সর্ব প্রথম এপিস্কোপ্যাল চার্চ এটি। ১৯’শ শতকে ইউরোপীয়দের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় তাদের কথা মাথায় রেখেই এই নির্মাণ করা।

আরেকটু সামনে লেনিন রোড, এর শুরুতেই দেখতে পাবেন মুঘল সম্রাজ্ঞী টিপু সুলতানের কনিষ্ঠ পুত্র প্রিন্স গোলাম মোহাম্মদের নির্মিত ঐতিহাসিক টিপু সুলতান মসজিদ।

মসজিদের ওপর পাশে আছে বাঙালির পরিচয় বহন করা ‘কে সি দাসের মিষ্টির দোকান’। মূলত কে সি দাসের দাদা নবীনচন্দ্র ছিলেন এই মিষ্টির কারিগর। তাকে ‘বউ বাজারের কলম্বাস’ বলে ডাকা হতো একসময়। দাদার ক্যারিশমাকে কে সি দাস ব্রান্ড করেছিলেন। ছানার রসগোল্লাসহ এখানে পাবেন ছানার পায়েস, অমৃত কলস, যা বাঙালির রসনাকে তৃপ্ত করার জন্য যথেষ্ট।

বউ বাজার অঞ্চল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম কলেজ স্ট্রিটে। বই প্রেমিক মানুষদের জন্য এম স্বর্গ রাজ্য। বউ বাজার অঞ্চলের গণেশ চন্দ্র এভিনিউ মোড় থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড মোড় পর্যন্ত দেড় কিলো রাস্তাটাই মূলত কলেজ স্ট্রিট। সারা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বইয়ের বাজার এটি। বলা হয়, যে বই কলেজ স্ট্রিটে পাওয়া যাবে না, সে বইয়ের অস্তিত্বই নেই। ভালো করে খুঁজলে আপনি কোনো কোনো বইয়ের মূল হাতে লেখা কপিও খুঁজে পেয়ে যেতে পারেন।

হাঁটতে হাঁটতে প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। খিদেও পেয়েছে জমপেশ। তাই দেরি না করে বাস ধরে সোজা চলে গেলাম পার্ক স্ট্রিট। এখানকার আরসালান বিরিয়ানি হাউজের আলাদা নাম ডাক শুনেছি। নিজে তাই স্বয়ং চলে এলাম নিজেকে বিরিয়ানি প্রেমিক প্রমাণের জন্য।

হোটেলের দ্বিতীয় তলাতে গিয়ে কোণার একটা টেবিলে বসলাম। মেনু কার্ড দেখে আমি বরাবরের মতো কনফিউজড হয়ে গেলাম। কী নাম! চিকন মাটন, হায়দ্রাবাদি, লখনৌ! এগুলো সব বিরিয়ানির নাম। ভাবা যায়! আর যারা নিরামিষ তাদের জন্য রিয়েছে ভেজিটেবল বিরিয়ানি। শেষে অর্ডার দিলাম লখনৌ। ওয়েটার প্লেটে বিরিয়ানি আনার পর আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। বিরিয়ানি না বিরিয়ানি ঢিবি? এত একজনের পক্ষে শেষ করা দুষ্কর। যা হোক খাওয়ার পর বুঝলাম কেন এর এত নাম ডাক।

কলকাতার পূর্বে পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে নিউটাউন। বিশ্ব বাংলা সরণি ধরে রাজারহাট। বলা যায় এটি নতুন কলকাতা। সব আইটি কোম্পানিসহ মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো এদিকে গড়ে উঠেছে। যেতে যেতে চোখে পড়বে নারকেল বাগানে বিশ্ব বাংলা রেস্টুরেন্ট, বিশ্ব বাংলা অডিটোরিয়াম, রবীন্দ্র তীর্থ। আরেকটু সামনে এগোলে ইকো পার্ক আর ঠিক তার দুই নম্বর গেটের বিপরীতে আছে মাদার ওয়াক্স মিউজিয়াম৷ এত দূর এসে কিছুই দেখা কপালে ছিল না। কারণ সোমবার এই এলাকাজুড়ে ছুটি। সব বিনোদনের স্পটগুলো বন্ধ থাকে।

কলকাতা দাদাদের শহর। এখানে সবাই দাদা। এখানে না এলে বাঙালিয়ানার যে স্বাদ তার ষোলকলা পূর্ণ হবে না। এখানে দেখার মতো আরও আছে হাওড়া ব্রিজ, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তি নিকেতন। খুব অল্প খরচে ঘুরতে চান? বের হয়ে যান। পরিবেশ সুস্থ রাখতে যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না।

লেখক: শিক্ষার্থী, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। ডিআইইউ/হাকিম মাহি