ক্যাম্পাস

কেমন হবে করোনা পরবর্তী পৃথিবী?

পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। নশ্বর এই গ্রহটি জন্ম থেকেই পরিবর্তিত হতে হতে এত দূর এসেছে। মানব জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনগুলোর কথা যদি চিন্তা করা হয়, তবে তা এসেছে যুদ্ধ থেকে। হ্যাঁ ঠিকই পড়ছেন, যুদ্ধই পৃথিবীর বড় পরিবর্তনগুলোর পেছনে দায়ী।

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিপ্লবগুলোর কথা বলতে গেলে শুরুতেই আসে ইন্টারনেট। এই ইন্টারনেট কিন্তু তৈরি হয় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর আমেরিকার সামরিক বাহিনীর মধ্যে নিজস্ব একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরির উদ্দেশ্যে। পরে তা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আবার এই যে আমরা মহাকাশে যাচ্ছি রকেটে চড়ে, সেই রকেট আবিষ্কারের চিন্তাও কিন্তু আসে যুদ্ধে ব্যবহৃত মারণাস্ত্র মিসাইল উদ্ভাবনের পর থেকে। অর্থাৎ যে সব বিষয়গুলা পৃথিবীকে নতুন একটি চেহারা এনে দিয়েছে, মানুষের জীবনযাত্রায় বড় পরিবর্তন সাধন করেছে, তার মূলেই আসলে ছিল যুদ্ধ অথবা সামরিক শক্তি। বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবী দুই-দুইটা বিশ্ব যুদ্ধের সাক্ষী হয়েছে। লম্বা একটা সময় পর পৃথিবী আবারো এক বিশ্ব যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করছে। তবে এবারের যুদ্ধটা গোলা বারুদ নিয়ে দৃশ্যমান শক্তির সঙ্গে নয়, এ এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার লড়াই। যার নাম করোনা। অন্যান্য যুদ্ধের মতো এই যুদ্ধও একটা না একটা সময় শেষ হবে, কিন্তু আমাদের চিরচেনা পৃথিবীটা তখন আর আগের মতো থাকবে না। তবে কি কি পরিবর্তন আসতে চলেছে করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে? দেখা যাক।

দ্রুত গতিতে সংগঠিত হবে ৪র্থ শিল্প বিপ্লব

বিশ্ব ইতোমধ্যেই ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে, উন্নত দেশগুলোর শিল্প কারখানায় স্বল্প পরিসরে মানুষের জায়গায় মেশিন ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সম্পূর্ণ রোবট কাজ করতে শুরু করেছে। করোনা এই বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করবে। ভবিষ্যতে করোনার মতো দুর্যোগে যেন কারখানা বন্ধ না হয়ে যায় সে উদ্দেশ্যে প্রডাকশনের বেশিরভাগ কাজই করা হবে রোবটের সাহায্যে।  আমাদের পরিচিত অনেক সেক্টরই  পরিবর্তিত হয়ে ডিজিটালাইজড হয়ে যাবে। শিল্প কারখানাগুলো মানুষের উপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে  রোবট ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সির দিকে ঝুঁকবে। কারণ রোবট সব রকমের দুর্যোগ উপেক্ষা করে মানুষের চেয়ে কম সময়ে নিরলসভাবে কাজ করতে পারে। একমাত্র সৃজনশীলতা ছাড়া সব ক্ষেত্রেই রোবট মানুষকে হারাবে। করোনা উত্তর পৃথিবীতে মানুষের অনেক কাজই রোবটকে করতে দেখা যাবে।    

ক্যাশলেস সোসাইটির দিকে ধাবিত হবে বিশ্ব

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মতো ক্যাশলেস সোসাইটির উদ্ভবও অনেক আগেই হয়ে গেছে। করোনার কারণে এর গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে বহুগুণে বেড়ে যাবে। ক্যাশলেস সোসাইটি মূলত এমন একটি সোসাইটির ধারণা, যেখানে সবপ্রকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংগঠিত হবে ক্যাশ বা ব্যাংকনোট বিহীন ই-পেমেন্ট সিস্টেমে। করোনার জীবাণুর অন্যতম বাহক নোট বা কাগজি-মুদ্রা। শুধু করোনায় না, গবেষণায় দেখা গেছে নোটগুলাতে মানব মলের মতো জীবাণুও থাকে। বিভিন্ন প্রকার জীবাণু একজন থেকে আর একজনের কাছে স্থানান্তর হওয়ার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ধরা হয় কাগজি মুদ্রাকে। করোনার পর মানুষ যতটা সম্ভব কাগজি মুদ্রা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবে এবং যাবতীয় লেনদেনের কাজই পেমেন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে করতে ইচ্ছুক হবে।

সুইডেন ইতোমধ্যে ক্যাশলেস সোসাইটির দিকে খানিকটা এগিয়ে গেছেভ। ২০১৬ সালে সুইডিশ নাগরিকরা তদের মোট অর্থনৈতিক লেনদেনের মাত্র ২ শতাংশ করেছেন ক্যাশ বা নোটের মাধ্যমে। আমাদের দেশেও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়ভাবে বাড়ছে। ভবিষ্যতের দিনগুলাতে মানুষ অর্থনৈতিক লেনদেন ই-পেমেন্ট সিস্টেমে করতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবে।   

জ্বালানী তেলের ব্যবহার কমবে

করোনার কারণে বিশ্ব বাজারে তেলের দর পানির সমান হতে চলেছে। লকডাউনে পড়ে থাকা বিশ্ববাসীর জ্বালানী তেলের প্রয়োজন এখন নেই বললেই চলে। আবার কিঞ্চিত পরিমাণ যাই চাহিদা থাকুক, পরিবহনের সু-ব্যবস্থা নেই। তাই দাম কমছে হুহু করে। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই যে জ্বালানী তেলের ব্যবসা পুরোপুরি আগের অবস্থানে ফিরে যাবে, সেটা আশা করা ঠিক হবে না। কারণ করোনার ফলে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের যে কালচার শুরু হয়েছে, তা অনেকাংশেই বহাল থাকবে। কোম্পানি ও কর্মচারী উভয়ই বুঝতে পারছে যে, প্রযুক্তির ব্যবহার করে ঘরে বসেও অনেক কাজ করা সম্ভব। যা তেলের ব্যবহার কিছুটা কমাবে।

এছাড়া মানুষের মধ্যে যে পরিবেশ সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে সেই সুযোগটিকে কাজে লাগাবে পরিবেশ বান্ধব ইলেকট্রিক কার। তেলের বিকল্প হিসেবে মানুষের মধ্যে ইলেকট্রিক কার ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যাবে, যার সুবাদে গ্রিন এনার্জির ব্যবহার বাড়বে। ফলস্বরূপ বছরের পর বছর জ্বালানী তেল পুড়িয়ে পৃথিবী তথা পরিবেশের যে ক্ষতি মানুষ করেছে, তা এবার একটু হলেও কমবে। তবে গ্রিন এনার্জি এবং ইলেকট্রিক কারের উত্থান, তেল সরবরাহকারী এবং ওপেকভুক্ত দেশগুলার জন্য এক অশনি সংকেত বটে।

চাহিদা কমে আসায় জ্বালানী তেলের ব্যবসায় বড় রকমের মন্দা চলছে। করোনার পর এই মন্দা কাঁটিয়ে উঠা কষ্টকর হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।  

কমে আসবে অস্ত্রের হুংকার

এত দিনে আমরা পরাশক্তি হিসেবে জেনে এসেছি সেই সব দেশগুলাকে, যারা মিলিটারি শক্তিতে বিশ্বসেরা। মিলিটারি পরাশক্তি হিসেবে যেই দেশগুলোকে আমরা চিনি, তারা যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো দেশকে আক্রমণ করতে প্রস্তুত এবং যেকোনো ধরনের আক্রমণ রুখে দেওয়ার ক্ষমতা তারা রাখে। কিন্তু করোনার পরবর্তী চিত্রটা একটু ভিন্ন হবে। একটা দেশ কতটা সুরক্ষিত বা উন্নত তা সে দেশের সৈন্য সামন্তের পাশাপাশি আরও একটি বিষয়ের উপর বিশেষভাবে বিবেচনা করা হবে, আর তা হলো সেই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা আধুনিক ও স্বয়ংসম্পন্ন।

দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার মতোই সন্মানের কাজ দেশের ক্রান্তিকালে মানুষের প্রাণ বাঁচানো। যেই কাজটা আমাদের ডাক্তাররা এখন করছেন।  আমেরিকা , ব্রিটেন , ফ্রান্সসহ বহু উন্নত দেশ করোনা মোকাবিলা করতে গিয়ে যেভাবে হিমশিম খেয়েছে, তা আমরা সবাই দেখেছি। অথচ এই দেশগুলো প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে যুদ্ধাস্ত্র কেনার পেছনে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এখন দেশগুলো বুঝতে পারছে অস্ত্রের মজুদের চেয়ে খাদ্যের মজুদ রাখাটা বেশি জরুরি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মতোই প্রয়োজন চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করা। করোনা উত্তর পৃথিবীতে অস্ত্রের গর্জন কমে যাবে, প্রতিরক্ষা ব্যয় কমিয়ে সেই অর্থ ব্যবহার হবে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে। চিকিৎসক, নার্স জনস্বাস্থ্য কর্মীরা এবার তাদের যথাযথ মর্যাদাটা পাবে।

অসির (তরবারি) চেয়ে মসি (কলম) অধিকতর শক্তিমান তা আমরা সবাই জানি। করোনা এবার আমাদের প্রমাণ করে দিতে চলেছে অসি বা রাইফেলের চেয়ে স্টেথোস্কোপ কোনো অংশেই কম নয়।

বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী মিলিটারি শক্তি নিয়েও আমেরিকার মতো একটি দেশ করোনা মোকাবিলাই ব্যর্থ হচ্ছে। করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে স্বাস্থ্য খাতকে।  

গণ-নজরদারি বাড়বে

সরকারি বিধিনিষেধ না মেনে, লকডাউন উপেক্ষা করে দায়িত্বহীনভাবে মানুষের চলাফেরা করার কারণে করোনা বেশি ছড়িয়েছে, তা আমরা সবাই জানি। কিছু মানুষের এই দায়িত্বহীনতার খেসারত চোকাতে হয়েছে বহু মানুষের মৃত্যুর মাধ্যমে। কেমন হত যদি সরকার আগে থেকেই জেনে যেত, কে অসুস্থ আর কে অসুস্থ না। অসুস্থ বা আক্রান্ত মানুষগুলোকে আটকিয়ে রাখতে পারলেই সংক্রামণ অনেকটাই রুখে দেওয়া যেত।

আসলেই অনেক ভালো হত এমনটা করা গেলে আর ঠিক এমনই হতে চলেছে আমাদের ভবিষ্যতের রাষ্ট্র ব্যবস্থায়। মানুষের এই দায়িত্বহীন আচরণের ফলে যেন ভবিষ্যতে আর বড় কোনো ক্ষতি না হয়, সে উদ্দেশ্যে নাগরিকদের উপর সূক্ষ্ম নজরদারি চালানো শুরু করবে বিভিন্ন দেশের সরকার।

বিখ্যাত লেখক ও ইতিহাসবিদ ইয়োভাল নোয়া হারারির ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত এক লেখায় তিনি আশংকা প্রকাশ করেছেন যে, করোনা উত্তর পৃথিবীতে এক গণ-নজরদারি রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব হতে পারে, যেখানে সরকার প্রতিটি নাগরিকের প্রতিটি মুহূর্তের চলাফেরা থেকে শুরু করে তার আবেগ-অনুভূতি, সুস্থতা অসুস্থতা, পছন্দ-অপছন্দের সব রকম তথ্য জেনে যাবে।

গণ-নজরদারির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে চীন। চীনের সরকার দেশটির সব জনগণের স্মার্টফোন মনিটর করছে। চেহারা চিনতে পারার ক্ষমতা সম্পূর্ণ লাখ লাখ ক্যামেরা দিয়ে নজর রাখা হচ্ছে মানুষের ওপর। লোকজনকে তাদের শরীরের তাপমাত্রা মাপাসহ, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য শেয়ার করতে বাধ্য করছে, ফলে সরকার দ্রুত শনাক্ত করতে পারছে কে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আর কে, না। এ কারণেই চীন করোনা যুদ্ধে সবার চেয়ে বেশি সফল। করোনা উত্তর পৃথিবিতে মানুষের উপর বাড়তে পারে রাষ্ট্রের নজরদারি। তবে নজরদারির ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও এর ফলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হবে।  

বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে করমর্দন প্রথা

পরিচিত-অপরিচিত কারো সাথে দেখা হওয়ার পর করমর্দন বা হ্যন্ডশেইখ করার পশ্চিমা প্রথা আমাদের সবার মধ্যেই বিরাজমান। রাজনৈতিকবর্গ থেকে শুরু করে করপোরেটের মধ্যে হরহামেশাই দেখা যায় এই ঐতিহ্যকে অনুসরণ করতে। কিন্তু করোনার পর বেশ বিতর্কিত হয়েছে বহুল প্রচলিত এই প্রথা।  আপাতত সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব ধরনের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলছে মানুষ। কিন্তু করোনা ভীতি আমাদের ভেতর যে অভ্যাস তৈরি করে দিচ্ছে, তা সহজে দূর হবে না। আর হ্যান্ডশেইখ জিনিসটা কখনোই খুব একটা স্বাস্থ্যকর ছিল না। রানি এলিজাবেথ গত কয়েক দশক ধরে হ্যন্ডশেইখ করেন না, আর করলেও হাতে সাদা গ্লাভস পরা অবস্থায় করেন। করোনার পর পুরো বিশ্ব তাকেই অনুসরণ করতে পারে এবং করমর্দন প্রথা হয়ে যেতে পারে ইতিহাস। করোনার সংক্রামণ রোধে লকডাউনের পূর্বেই অনেক অফিস আদালতে                                   হ্যান্ডশেইখ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। 

করোনা এক মহা দুর্যোগের নাম। যার প্রকোপে থেমে আছে পুরো পৃথিবী, বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। কিন্তু এটাও সত্য, এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। এই করোনাও এক সময় বিদায় নেবে। আর আমাদের জন্য রেখে যাবে পরিবর্তিত এক পৃথিবী। মানুষ হিসেবে আমরা যত দ্রুত সেই পরিবর্তনগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারব, আমাদের জন্য ততই মঙ্গল। সবাই ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন। আলো আসবেই…।  

লেখক: শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

 

ইবি/হাকিম মাহি