ক্যাম্পাস

‘এমন ঈদ আর না আসুক’

ঈদ মানে আনন্দের জোয়ার। ঈদ মানে খুশির সঞ্চার। কিন্তু এবারের ঈদে নেমে এসেছে মহামারি করোনার কালো অধ্যায়। যা ঈদের সব আমেজকে বিলীন করে দিয়েছে। বারণ করে দিয়েছে চিরায়ত সব পরিকল্পনাকে।

দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর রমজানের শেষ দিনে আকাশের এক কোণে বাঁকা চাঁদের মিষ্টি হাসি ঈদের জানান দিয়ে দেয় সবাইকে, সবাই একই সুরে গেয়ে ওঠে কাজী নজরুল ইসলামের সেই অমর সংগীত, ‘ও মোর রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ কিন্তু এ বছর সেই বাঁকা চাঁদের মিষ্টি হাসিটা দেখার জন্যও হয়তো কেউ ঘর থেকে বের হয়নি। কারণ, বাইরে ওঁৎ পেতে বসে আছে মহা শত্রু করোনা।

প্রতি বছর এ সময়টাতে মানুষের মাঝে ঈদের কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম প্রস্তুতি থাকে তুঙ্গে। বাহারি রঙের জামা কাপড় কেনার ধুম পড়ে যায়। সবাই মার্কেট বা শপিং মলে গিয়ে নিজের পছন্দমত কিনে প্রিয় পোশাকটি। সাথে থাকে প্রিয় মানুষদের জন্য উপহার। পরিবারের সবাই দলবেঁধে একসাথে মার্কেটে গিয়ে শপিং করার মতো আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু এবারের দৃশ্যপট পুরো অকল্পনীয়। ঈদের আগে তার অনেকটাই হয়নি।

ঈদের সকালে অনেক জায়গায় হয়নি ঈদের নামাজও। হয়নি কোলাকুলি, করমর্দন কিংবা বন্ধু বন্ধুকে জড়িয়ে ধরা। সবার মধ্যেই এক অজানা ভয়, কখন কার কী হয়ে যায়।

বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে বদলে গেছে এ বারের ঈদের দৃশ্যপট, হারিয়ে গেছে ঈদের চিরচেনা আমেজ।

বাসার অবুঝ ছোট বাচ্চাটিও আব্বু আম্মুর কাছে ঈদের জামা কিনে দেওয়ার জন্য বায়না ধরেছিল। বলেছিল, ‘আব্বু তুমি এইবার আমাকে নতুন জামা কিনে দাওনি কেন?’ বাবার কাছ থেকে গিয়ে মাকে বলছিল, ‘আম্মু, আব্বু এইবার আমাদের মার্কেটে নিয়ে যায়নি কেন?’ অবুঝ শিশুটি তো আর বোঝে না করোনাভাইরাস কী, লকডাউন কী! নিষ্পাপ শিশুর আবদারও হার মেনেছে বিধ্বংসী করোনার কাছে।

আমরা কেউ এক মুহূর্তের জন্য ভুলেও কল্পনা করিনি এইবারের ঈদ আমাদের এমনভাবে কাটাতে হবে। পরিবারের একমাত্র চাকরিজীবী মানুষটা জীবিকার তাগিদে শহরে থাকার কারণে পরিবারের আপনজনদের ছাড়াই শহরের চার দেয়ালে কক্ষে বুক ভরা হাহাকার নিয়ে কাটাতে হচ্ছে এইবারের ঈদ।

জীবনযাত্রার তাগিদে শহরে থাকা মানুষজন যেতে পারেনি নিজের জন্মস্থান বেড়ে ওঠা নির্জন গ্রামে। প্রতিবারের মতো এইবার আর গ্রামের মায়াবী পরিবেশে, পরিবারের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারবেন না।

প্রতিবছর ঈদের নামাজ শেষে ঈদগাহ ময়দানে সবাই সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সব ভেদাভেদ, দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে একে অপরকে বুকে জড়িয়ে নেয়। কিন্তু এ বছর এ সম্প্রীতিতে আঘাত হেনেছে বিধ্বংসী করোনা। হাতে হাত, বুকে বুক লাগানোতে রয়েছে করোনার নিষেধাজ্ঞা।

চিরায়ত নিয়মানুযায়ী ঈদের দিন নতুন জামাকাপড় পরিধান করে সবাই ছুটে যেতো আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে। ঈদের দিন বাড়ি ভরপুর থাকতো মেহমানে। কত বিচিত্র ধরনের খাবার তৈরি করে রাখা হতো। ছেলেমেয়েরা বড়দের সালাম করতো এবং সালামির অপেক্ষায় থাকতো। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সালামির রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু এবারের দৃশ্যপট পুরো ভিন্ন। করোনাকে ঠেকাতে সব কিছু লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। একে অপরের বাড়িতে যাওয়াতেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তাই এবার কেউ কোনো দিকে, কারো বাড়িতে যেতে পারবে না। ভাগাভাগি করে নিতে পারবে না চিরায়ত ঈদ আনন্দকে।

করোনা থেকে বাঁচতে হলে, জীবনকে বাঁচাতে হলে এই মুহূর্তে বেঁচে থাকার লড়াইটাই আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। আর এর জন্য আমাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, ঘরে অবস্থান করতে হবে।

আমরা কেউই ক্ষণিকের জন্যেও বিন্দুমাত্র কল্পনা করিনি আমাদের এবারের ঈদ ঘরবন্দি হয়ে, আপনজনদের ছাড়া এমনভাবে কাটাতে হবে। দুর্যোগ-মহামারি-সময়ের সাথে লড়াই করে আমাদের তো বেঁচে থাকতে হবে। জীবনে বেঁচে থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এমন ঈদ আর কখনো চাই না, এমন ঈদ আর কখনো যেন আমাদের মাঝে না আসে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। চবি/হাকিম মাহি