ক্যাম্পাস

শতবর্ষে ঢাবি: কালের সাক্ষী কড়ই গাছ

একটি রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে রয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়। আর সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িয়ে রয়েছে আরেক ইতিহাসের সাক্ষী, যে সাক্ষীর বয়স সেই রাষ্ট্র, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়সের চেয়েও অনেক বেশি। আর সেই সাক্ষী হচ্ছে একটি কড়ই গাছ। একটি জাতির ইতিহাসের সাথেই জড়িয়ে রয়েছে যার নাম। এ যেন রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়ে দেয়।

১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। দীর্ঘ দিনের পথচলায় ৯৯ বছর পূর্ণ করে একশোর আঙিনায় পা রাখছে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মেরও ৫০ বছর পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই রাষ্ট্রের সমস্ত অর্জনের নীরব সাক্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, বরং এর প্রতিটি ইট-পাথর, গাছ-পাতা, সড়ক-সবই যেন যুগ যুগ ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত ঐতিহাসিক অংশীদারগুলোর গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো অবকাশ আমাদের নেই।

একশো বছরের পথচলায় কালের পরিক্রমায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানের অনন্য কিছু নামকরণ করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সবার মুখে মুখে প্রচলিত হওয়ায় এই নামগুলো স্থায়ীভাবে জড়িয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে। এ কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলতেই শিক্ষার্থীদের কল্পনায় ভেসে ওঠে হাকিম চত্বর, মিলন চত্বর, ভিসি চত্বর কিংবা মল চত্বরের নাম, যেন এক অলিখিত সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়েছে এই নামগুলো।

প্রতিটি চত্বরের সাথে শিক্ষার্থীদের যে স্মৃতিময় সম্পর্ক রয়েছে, তার নিরিখে এই নামগুলোর মধ্যে প্রাণের সঞ্চারণ ঘটেছে নতুন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে এমনই এক স্মৃতি বিধুর আবেগের নাম ভিসি চত্বর, যার সাথে জড়িয়ে আছে প্রত্যেকের ফেলে আসা দিনের হাজারো রঙিন গল্প। টিএসসি-নীলক্ষেত সড়ক আর ফুলার রোডের ত্রিমোহনার স্থানটির নামই ভিসি চত্বর৷ এই নামকরণের পেছনের কারণটিও অবশ্য সবার বোধগম্য হওয়ার কথা। এই চত্বরটির পাশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন। ভিসি বাংলোর পাশের এই চত্বরটির নামও তাই শিক্ষার্থীরাই দিয়েছেন ভিসি চত্বর। বছরের পর বছর ধরে সে নামেই সবার কাছে পরিচিত এই স্থানটি।

ভিসি চত্বরের কেন্দ্রবিন্দুতে স্মৃতি চিরন্তনের ঠিক পাশেই সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল এক কড়ই (রেইনট্রি) গাছ। এ গাছটির বয়স বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়সের চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ বেশি। অনেকে বলছেন গাছটির বয়স প্রায় ১৫০ বছর।  জন্মের শুরু থেকে আজ অবধি অজস্র মুহূর্তের নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাছটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব আবাসিক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে যাতায়াত করেন, তাদের জন্য ভিসি চত্বর এক স্টেশনের নাম, যে স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকেই রোজ বাড়ি ফেরার যাত্রা শুরু হয় তাদের। যাত্রার পূর্বে সারাদিন ক্লান্তি ভুলতে এই কড়ই গাছের নিচেই ঠাঁই হয় সবার। ক্লাস-পরীক্ষা-অ্যাসাইনমেন্টের নিত্য ব্যস্ততা শেষে গোধূলিবেলায় শিক্ষার্থীরা প্রাণ ফিরে পায় এই গাছটির কাছে এসে।

প্রতিদিন হাজারো শিক্ষার্থীর মিলনমেলা বসে এই কড়ই গাছের নিচে। শিক্ষার্থীদের বসার জন্য প্রশাসন গাছটির চারপাশে শান বাঁধিয়ে দিয়েছে, যার ফলে স্থানটির আকর্ষণ বেড়েছে বহুগুণে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এই বিস্তৃত গাছটির নিচেই এক টুকরো স্বস্তির খোঁজ করে সবাই। কোনো আনমনে ছেলে তার বেসুরো গলায় গান ধরে, পাশের বন্ধুটির গিটার তাকে সঙ্গ দেয়। কারো বা চলে বন্ধুর সাথে আড্ডা আর খুনসুটি।

এখানে চা বিক্রেতারা আসে, ওয়ান টাইম কাপে চা দিয়ে গল্প জমিয়ে ফেলে কোনো এক অচেনা ক্রেতার সাথে। চা বিক্রেতা, বাদাম বিক্রেতারাও যেন আপন হয়ে ওঠে এই স্থানটিতে এসে। গভীর রাতেও হলের ছাত্রদের আনাগোনায় মুখর থাকে এ প্রাঙ্গণ, রাতভর চলে গান-গল্প-আড্ডা। আর এতসব নিত্য ঘটনা চুপচাপ তাকিয়ে দেখে এই পুরনো কড়ই গাছটি।

এই গাছটিকে বা কারা এখানে রোপণ করেছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের ভাষ্যমতে, এই গাছটির বয়স দেড়শো বছরের মতো। ধারণা করা হয়, ১৮৭০ থেকে ১৮৭৫ এর মধ্যবর্তী সময়ে পুরান ঢাকার কোনো এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের কর্তা এই গাছটি রোপণ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন, এক ব্রিটিশ ভদ্রলোকের হাত ধরেই গাছটির পথচলা শুরু৷ তবে সমস্ত তথ্যসূত্র থেকে এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, গাছটির বয়স দেড়শো বছর বা এর কাছাকাছি। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও অন্তত ৫০ বছর পূর্বে গাছটির বেড়ে ওঠা শুরু। তখন এখানে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, আজকের এই প্রশস্ত সড়ক, স্মৃতির মিনার, ফুটপাত, ভিসি বাংলো, ফুলার রোডের সুউঁচ্চ ভবন তখন ছিল না।

হয়তোবা স্থানটি ফাঁকা ছিল, খুব অল্প মানুষের যাতায়াত হতো, কিংবা হয়তো কেউ আসতই না এদিকে! তখন তো পুরো ঢাকা শহরের বিশাল অংশই ফাঁকা পড়ে ছিল। এই নির্জনতার মাঝেই গাছটি একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে। ছড়িয়ে পড়েছে তার ডালপালা। এভাবে একদিন গাছটির চোখের সামনেই এখানে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে, বেড়েছে মানুষের আনাগোনা। কত শত শিক্ষার্থী এই গাছের নিচে বসে আড্ডা দিয়েছে, কত প্রেমিক তার প্রেমিকার হাত ধরেছে, এই গাছটির নিচে বসেই কোনো উদভ্রান্ত কবি তার কবিতার খাতায় শব্দের আঁকিবুঁকি করেছে, শিল্পী এঁকেছে ছবি আর গাছটি শুধু নিষ্পলক তাকিয়ে দেখেছে, তাঁর তো আর বলার ভাষা নেই!

শিক্ষার্থীদের এসব স্মৃতির সাথে সাথে আরও অনেক ঐতিহাসিক ঘটনারও সাক্ষী হয়ে রয়েছে এই কড়ই গাছটি। পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহ দু'টি বিশ্বযুদ্ধ এই গাছটি প্রত্যক্ষ করেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়েও নানা মিছিল-মিটিং এর সাক্ষী ছিল এ গাছ। সাক্ষী ছিল ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য আগ্রহী শ্রোতারা এই গাছের পাশ দিয়েই হেঁটে গেছেন। স্বাধীনতাকামী হাজারো ছাত্র জনতার মিছিল চলে গেছে এ পথ ধরেই। ২৫ মার্চে কালরাতে যখন পাকিস্তানি হানাদারের আবাসিক হলগুলোতে আক্রমণ চালালো, তখনো গাছটি দেখেছে ইতিহাসের নির্মমতা। হাজারো শহীদের স্মৃতির সাক্ষী এই গাছ৷ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মও এই গাছটির সামনেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও অজস্র ঐতিহাসিক ঘটনাকে বুকে লালন করে গাছটি বেঁচে রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাবিল হাসান বলেন, সময় পেলেই আমরা বন্ধুরা মিলে এখানে আসি, এসে গান করি। বন্ধুরা সবসময় ক্লাসে ব্যস্ত থাকে, অবসরে ওরা সবাই এখানে আসে।  ভিসি চত্বরকে এক কথায় বলা যায় মিলনমেলা।

আর কয়েক দশক পরেই হয়তো গাছটি ভেঙে পড়বে, ক্লান্তিকর এ পথচলা শেষ হবে গাছটির। কিন্তু যে ইতিহাস, গৌরব আর ঐতিহ্যের অংশীদার এই কড়ই গাছটি হয়েছে, তার কখনো মৃত্যু হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর বুকে আজীবন গাছটির স্মৃতি লিখিত থাকবে। এই গাছটির প্রতিটি পাতায় পাতায় লেখা থাকবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাস, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস। লেখা থাকবে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির ইতিহাস। শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সার্ধশতবর্ষী গাছটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব সবসময়ই থাকবে তাৎপর্যপূর্ণ।

লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ঢাবি/হাকিম মাহি