ক্যাম্পাস

ইতিহাসের বাঁকবদল

প্রখ্যাত জার্মান ঐতিহাসিক লিওপোল্ড ফন বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছিল তার অনুসন্ধান বা বিবরণই হলো ইতিহাস।  জি. জে রেনিয়ার বলেছেন, সভ্য সমাজে বসবাসকারী মানুষদের অভিজ্ঞতার কাহিনিই ইতিহাস।

আবার কেউবা বলে থাকেন মানুষের অতীত কালের বিদ্যমান জীবনব্যবস্থা ও ক্রিয়াকলাপের পর্যালোচনা ও লিপিবদ্ধতাকেই ইতিহাস বলে। অতীতের বিভিন্ন ঘটনা ঐতিহাসিকরা পর্যালোচনা করে সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন, যাকে কালক্রমে আমরা ইতিহাস বলে থাকি। এমন কিছু অতীতের উল্লেখযোগ্য সমাজের ঘটনা বা মানবের জীবনযাত্রার ঘটনা রয়েছে, যেগুলো স্থান পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়।

এমন ঘটনার সংস্পর্শে বলা যেতে পারে বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সৃষ্টি করেছে তার ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা। শুধু যে করোনাভাইরাসই এমন আতঙ্ক বা ভয়াবহতা তৈরি করেছে তা নয়, বরং এমন অনেক ভাইরাস বা দুর্যোগ এসেছে বা ঘটনা ঘটেছে ইতিহাস পড়ে আমরা সেগুলো জানি।

পর্যালোচনা করলে আরেকটু স্পষ্ট বোঝা যায়, করোনার পূর্বে গুটিবসন্ত এবং যক্ষ্মার মতো অনেকগুলি মহামারি দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক মহামারিগুলোর মধ্যে একটি ছিল ব্ল্যাক ডেথ (প্লেগ নামেও পরিচিত), যাতে ১৪ শতকে আনুমানিক ৭৫-২০০ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য মহামারীর মধ্যে রয়েছে ১৯১৮ ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি (স্প্যানিশ ফ্লু) এবং ২০০৯ ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি (এইচ১এন১)। বর্তমান মহামারিগুলোর মধ্যে এইচআইভি/এইডস এবং কোভিড-১৯ মহামারি অন্তর্ভুক্ত।

এছাড়া ১৭২০-১৭২১ সালে মার্সেইয়ের মহামারি উল্লেখযোগ্য। স্প্যানিশ ফ্লু (১৯১৮ থেকে ১৯২০) - এটি সারা বিশ্বের ৫০০ মিলিয়ন মানুষকে সংক্রমিত করেছিল‌। উনিশ শতকে এটি ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল, যাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল।

১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে এইচ২এন২ ভাইরাস প্রথম চিনে শনাক্ত করা হয়েছিল। এতে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। হংকং ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু ছাড়াও গুটিবসন্ত একটি সংক্রামক রোগ, যা ভেরিওলা ভাইরাস দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল।

এই সব ভাইরাসের ফলে মারা গিয়েছে কোটি কোটি মানুষ। সৃষ্ট হয়েছে মহামারির সাথে দুর্ভিক্ষ বা মন্দাও‌। কালক্রমে অবসান ঘটেছে নানা সভ্যতার। পরাক্ষন্তরে জন্মও নিয়েছে নতুন নতুন সভ্যতা। সৃষ্টি হয়েছে মানুষের নতুন জগৎ, আর অতীতের জীবন প্রণালীগুলো ঠাঁই পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়।

তাদের মহামারিকালীন নানা অসচেতনতা, চিকিৎসার অভাব, প্রতিনিয়ত সংক্রমণ বৃদ্ধি সেই সব ইতিহাস যেন এখন রচনা হতে চলেছে। কেননা অতীতের প্রেক্ষাপটের সাথে বাস্তব সময়ের রয়েছে দারুণ মিল। এছাড়া এবার দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের।

প্রবল আম্ফানের তীব্র ঝড় ও বৃষ্টি তাদের বহুলাংশে ফসল ধ্বংসসহ ঘর-বাড়ি উজাড় করেছে। পাশাপাশি আষাঢ়ের বৃষ্টি আর বন্যা তাদের উপর যেন ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে’। এছাড়া সাম্প্রতিক কালে দিল্লির পতঙ্গপালের আগমন আর শস্য বিধ্বস্ত করে দেওয়ার ঘটনা যেন বড়ই আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে মানুষের মনে। তবে কি আমরা মন্দার পথেই চলছি?

তার উপরে আবার করোনার মতো মহামারি। টেনে হিঁচড়ে কি‌ তবে আমরা ১৯৩০ এর দশকের বিশ্বব্যাপী সংঘটিত মন্দা বা একবিংশ শতাব্দীতে ঘ‌টিত  মহামন্দা, যা বিশ্ব অর্থনীতির পতনের মতো ঘটনার সম্মুখীন হতে যাচ্ছি? এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় মন্দা ১৯২৯ সালে দেখা দেয়, যা বিংশ শতাব্দীর দীর্ঘতম মন্দা বলা চলে।

বিভিন্ন শহরে মহামন্দার প্রভাব তীব্র ছিল, বিশেষ করে যেসব শহর ভারী শিল্পের উপর নির্ভরশীল ছিল। অনেক দেশে নির্মাণকাজ বন্ধই ছিল। কৃষক সম্প্রদায় ও গ্রাম্য এলাকাসমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। এবারও যেন তেমন কিছুর সম্মুখীন হতেই চলেছি আমরা। কেননা কৃষকের ফসলের বেহাল দশা।

জনগণের কাজ বন্ধ, কর্মহীন প্রায় কোটি কোটি মানুষ। এতে মৃত্যুবরণ করেন অনেকেই। আবার যদি দুর্ভিক্ষের কথা বলি, তবে দুর্ভিক্ষ হলো কোনো এলাকার ব্যাপক খাদ্যর অভাব বা সরকারের নীতিগত ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে দুর্ভিক্ষ হয়। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গবাদিপশুর মড়ক, পোকার আক্রমণ, ফসলহানি ইত্যাদি কারণেও দুর্ভিক্ষ হয়।

তেমনি করোনার এই ক্রান্তিলগ্নেও আমরা সেই চিত্রই প্রত্যাক্ষ করতে পারি।  এবারও ঘটেছে ব্যাপক ফসলহানি, পাশাপাশি ঘটেছে পঙ্গপালের মতো ভয়াবহ পোকার আক্রমণ। যা মানুষের খাদ্যর সংকট সৃষ্টিতে বদ্ধ পরিকর। প্রাচীন গ্রন্থ ও ইতিহাসে এমন পোকার কথা শোনা যায়। শোনা যায় সেসব ভয়াবহ মুহূর্ত ও দিনগুলোর কথা।

তবে কি সময়‌ এবার আমাদের? এ যাবৎকালে ১৭৭০ সালে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল দেশে। বাংলা ১১৭৬ সাল হওয়ায় এই সময়টি দুর্ভিক্ষের ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত লাভ করে। পাশাপাশি অতি বৃষ্টি ও বন্যার কারণে কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় দেশজুড়ে চরম অর্থনৈতিক মন্দারও দেখা মেলে।

আবার ১৯৪৩ ও ১৯৭৪ সালেও একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ‌কৃষির ক্ষতি হয়েছিল ব্যাপক। দালাল ফরিয়াদের ফলে তা আবার প্রকট রূপ লাভ করে। এছাড়া ১৯৫৮-৬১ সালে চীনের মহাদুর্ভিক্ষে শুধু চীনেই মারা যান ৩০ মিলিয়ন মানুষ। বিংশ শতাব্দীর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দুর্ভিক্ষ হলো, ১৯৬০ সালে বায়াফ্রা দুর্ভিক্ষ, ১৯৭০ সালে কাম্বোডিয়া দুর্ভিক্ষ, ১৯৯০ সালে উত্তর কোরিয়ার দুর্ভিক্ষ।

এছাড়া ১৯৮৩-৮৪ সালে ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষ। তবে কি ২০২০ সালও এমন হতে চলেছে? ২০২০ থেকেই কি শুরু হবে মহামারি, মহামন্দা বা দুর্ভিক্ষ?

ইতিহাসের মতো এই সালও কি হতে যাচ্ছে একটি অভিশপ্ত বছর। সেই অভিশপ্ত বছরেরই সভ্য সমাজ আমরা। জন্ম দিতে চলেছি কি নতুন ইতিহাসের, কিংবা বাঁক বদল করতে যাচ্ছি নতুন সভ্যতার? আমরা কি তবে ইতিহাসের পাতায় উঠতে যাচ্ছি, নাকি সভ্যতার বাঁক বদল ঘটাতে?

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ইবি/মাহি