ক্যাম্পাস

স্তনকর ও একটি নির্মম প্রতিবাদ

সাল ১৮০৩, স্থান কেরালার চেরথালা। সমুদ্রের পাশেই সাজানো গোছানো ছোট্ট একটা শহর। আজ থেকে প্রায় ২১৫ বছর আগের কথা। সে সময় কেরালার রাজা ছিলেন ত্রিভাঙ্কুর/ত্রিবাঙ্কুর। আজব দেশের এই আজব শাসক বিভিন্ন আজব আজব করের নামে নিম্নবর্ণের বা দলিত শ্রেণীর মানুষকে শোষণ করতেন।

সে সময় নিম্নবর্ণের নারী-পুরুষকে নির্বিশেষে অলঙ্কার পরিধানের জন্য কর দিতে হত। পুরুষরা গোঁফ রাখতে চাইলে কর দিতে হতো। এর চেয়েও ঘৃণ্য এক কর ছিল– স্তনকর বা স্তনশুল্ক। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হতো ‘মূলাক্করম’। তখন নিয়ম ছিল ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কোনো হিন্দু নারী তার স্তন ঢেকে রাখতে পারবে না। শুধু ব্রাহ্মণ শ্রেণীর হিন্দু নারীরা তাদের স্তন এক টুকরো সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারতো, বাকি হিন্দু শ্রেণীর নারীদের প্রকাশ্যে স্তন উন্মুক্ত করে রাখতে হতো।

এখন আসি স্তন কর বা ব্রেস্ট ট্যাক্স কী?

সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বুকের উত্থিত মাংশপিণ্ডকে স্তন বলা হয়। মূলত দক্ষিণ ভারতের নিম্ন-বর্ণেরহিন্দু মহিলারা গায়ে বিশেষ করে বুকের ওপর কোনো কাপড় পরিধান করতে পারতো না। তাদের স্তন সবসময় উন্মুক্ত করে রাখতে হতো। তারা যদি বুকের ওপর কোনো কাপড় পরিধান করতে ইচ্ছা পোষণ করতো, তবে তাদের স্তন কর বা ব্রেস্ট ট্যাক্স প্রদান করতে হতো। এমন একটি আইন বা নিয়ম উনিশ শতকের প্রথম দিকে দক্ষিণ ভারতে চালু ছিল। আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য অনেক নিম্নবর্ণের হিন্দু মহিলারা অনেকটা বাধ্য হয়েই এই বর্ণ ভিত্তিক স্তন কর বা ব্রেস্ট ট্যাক্স প্রদান করে থাকতো।

এই করের ধরন কেমন ছিল?

স্তনের আকারের উপর ভিত্তি করে এই কর ধার্য করা হতো। যেমন-যেসব নিম্নবর্ণের হিন্দু মহিলার স্তন ছোট ছিল, তাদের অল্প কর বা অল্প ট্যাক্স প্রদান করতে হতো। কিন্তু সমস্যা ছিল ঐ সমস্ত মহিলাদের, যাদের স্তনের আকার ছিল বড়। তাদের বড় আকারের স্তনের জন্য বেশি পরিমাণ কর বা ট্যাক্স প্রদান করতে বাধ্য করা হতো। এক কথায় ছোট স্তনে ছোট কর বড় স্তনে বড় কর।

কাদের জন্য প্রযোজ্য ছিল এই আইন?

সব হিন্দু মহিলাদের জন্য এই আইন প্রযোজ্য ছিল না। হিন্দুদের মধ্যে যারা উঁচু বর্ণের ব্রাহ্মণ শ্রেণীর মহিলা ছিল, তাদের এই কর বা ট্যাক্স দিতে হতো না এবং তারা বুকের ওপর কাপড় পরিধান করার একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করতো। আর এই আইনের করাতলে শোষিত হতো নিম্নবর্ণের নারীরা।

সমাজের উঁচু শ্রেণীর কিছু ব্যক্তি ও তাদের সহযোগী বিশেষ সুবিধাভোগী কিছু অংশের লোকেরাই এই আইন প্রয়োগ করে মূলত নিম্নবর্ণের মানুষকে শাসন ও শোষণ করতো। এক কথায় জোর যার মুল্লুক তার নীতি গ্রহণ করা হতো। তবে এই আইন বেশিদিন টিকতে পারেনি। নিচু শ্রেণীর লোকদের সম্মিলিত প্রতিবাদে ধ্বংস হয়েছিল এই আইন। নিম্নবর্ণের এক মহিলাই সর্বপ্রথম এর প্রতিবাদ করেছিল।

কে সেই মহিলা, যে প্রথম প্রতিবাদ করেছিল?

সর্বপ্রথম যে মহিলা এর প্রতিবাদ করেছিল, তাঁর নাম ছিল নাঙ্গেলি। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের ট্রাভানকোর রাজ্যের চেরথালায় বাস করতেন নাঙ্গেলি নামের এজহাভা গোত্রের নিম্নহিন্দু বর্ণের এই মহিলাটি। তার স্বামীর নাম ছিল চিরুকান্দান। এই দম্পতি ছিল নিঃসন্তান। তারা ছিল অতি সাধারণ মানুষ। চাষাবাদ করে জীবন নির্বাহ করতো।

কী ঘটেছিল সেদিন?

অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও ট্রাভানকোরের স্থানীয় শুল্ক কর্মকর্তা, যে কিনা স্তন কর সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করতো, সে নাঙ্গেলির বাড়িতে এসেছিল নিম্নবর্ণের হিন্দু নারীদের বুকে কাপড় পরিধান করা বা না করার বিষয়টি জরিপ করতে এবং কর সংগ্রহ করতে। কর্মকর্তা দেখতে পেলো যে নাঙ্গেলি তার বুকে স্তনের ওপর কাপড় পরিধান করে আছে। কর্মকর্তা নাঙ্গেলির কাছ থেকে এজন্য কর দাবি করলো এবং তাকে বারবার কর পরিশোধের জন্য চাপ দিতে লাগলো। কিন্তু নাঙ্গেলি স্তন কর দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এভাবে দিনের পর দিন শুল্ক সংগ্রাহক তার বাড়িতে এসে শুল্কের দাবি আদায়ে চাপ প্রয়োগ করতে লাগলো এবং বিষয়টি মন্দিরের পুরোহিতদের এবং স্থানীয় উচ্চবর্ণের ব্রাক্ষণদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। শুল্ক কর্মকর্তা শুল্ক প্রদানের জন্য নাঙ্গেলিকে আরও বেশি চাপ প্রয়োগ করতে থাকে এবং তাকে অতিষ্ট করে তুলে। এদিকে দিনের পর দিন করের বোঝাও বাড়তে থাকে।

অবশেষে একদিন নাঙ্গেলি স্তন কর প্রদান করতে রাজি হয়। নির্দিষ্ট দিনে কর সংগ্রাহকেরা তার বাড়িতে কর সংগ্রহ করতে এলে তিনি তাদেরকে অপেক্ষা করতে বলেন। এরপর নাঙ্গেলি ঘরের ভেতর প্রবেশ করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার স্তন দুটি কেটে ফেলেন। কলাপাতায় রক্তমাখা স্তন দুটি মুড়িয়ে স্তন শুল্ক হিসেবে তার কর্তিত ও রক্তাক্ত স্তন দুটি শুল্ক কর্মকর্তার হাতে তুলে দেন। স্তন কর্তনের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নাঙ্গেলির মৃত্যু হয়। নাঙ্গেলির স্বামী চিরুকান্দান নাঙ্গেলির বিকৃত মৃতদেহ দেখে শোক সহ্য করতে পারলেন না। তিনি নাঙ্গেলির শেষকৃত্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে চিতায় আত্মহুতি দিলেন। ভারতে সম্ভবত সেটাই ছিল পুরুষের প্রথম সতীদাহ।

এই বর্ণ বৈষম্যের ফলে ঐ অঞ্চলে কী ঘটেছিল?

নিজের নারীত্ব অভিশাপ হয়ে বেঁচে থাকুক নাঙ্গেলি সেটা চাননি। তিনি বর্ণপ্রথা মানতে চাননি। তিনি চাননি, ভোগ্যপণ্যের মতো তার শরীরের উপর কর আরোপিত হোক। এর প্রতিবাদস্বরূপ সে তাঁর স্তন কেটে ফেলে। তার মৃত্যুবরণের ঘটনায় সবাই ফুসে উঠে। মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। অবশেষে রাজা রহিত করতে বাধ্য হয় বর্বর সেই স্তনকর প্রথা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়টি হচ্ছে খোদ হিন্দু পুরোহিতরাই তখন বলেছিল যে, নিচু বর্ণের নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করা ধর্ম বিরোধী।

নাঙ্গেলির মৃত্যুতে স্তনকর রহিত হলেও শরীর আবৃত অনাবৃত রাখা না রাখা নিয়ে অনেক ঘটনার জন্ম হয় ভারতবর্ষে। এমনকি ১৮৫৯ সালে এই বিষয়টি নিয়ে দক্ষিণ ভারতে একটি দাঙ্গাও সংগঠিত হয়। এই দাঙ্গাটি ‘কাপড়ের দাঙ্গা’ হিসেবে পরিচিত। দাঙ্গার বিষয় ছিল, নারীদের শরীর আবৃত রাখার অধিকার। যে অধিকারের জন্যে ১৮৫৯ সালের দাঙ্গার অনেক বছর আগেই প্রাণ দিয়েছিলেন এক হতভাগ্য নারী নাঙ্গেলি। 

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা/মাহি