সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে উপন্যাস সর্বাধুনিক এবং সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শাখা। উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে ঊনবিংশ শতাব্দী খুবই তাৎপর্যবহ। এই শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাসের প্রবর্তন হয়। বাংলা সাহিত্যকে বিকাশের শীর্ষ স্তরে পৌঁছে দেওয়া এসব মহৎ উপন্যাস পাঠকের মনকে যুক্ত করে বৃহত্তর জগৎ ও জীবনের সঙ্গে। উনিশ শতক ও বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত রচিত কিছু উপন্যাস এবং এদের রূপকারদের নিয়েই আজকের এই আলোচনা।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে নিজেদের গৌরবকে যেন প্রতিষ্ঠা করা যায় সেজন্যে যেসব মানুষ চেষ্টা করেছিলেন, জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে বাংলার মানুষকে উন্নতভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন তাদেরই অন্যতম।
তিনিই বাংলা সাহিত্যে প্রথম পাশ্চাত্য আদর্শের প্রভাবে সার্থক উপন্যাস রচনা করেছেন এবং প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি বাঙালির জীবন ও ইতিহাস থেকে উপকরণ নিয়ে উপন্যাসের পথরেখা নির্মাণ করেন।
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সাহিত্যিক জীবনের বাইশ বছরে ১৪টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তার প্রথম বাংলা উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫)। এটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। এরপর প্রকাশিত হয়-কপালকুন্ডলা (১৮৬৬) ও মৃণালিনী (১৮৬৯)। এই তিনটি উপন্যাস প্রকাশের সাথে সাথে ইংরেজি শিক্ষিত মহলে বাংলা উপন্যাসের সাহিত্যিক স্বীকৃতি দৃঢ় হয়। তাঁর অন্যান্য কিছু আলোচিত উপন্যাস-কমলাকান্তের দপ্তর (১৮৭৫), কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮) ও বিষবৃক্ষ (১৯৭০)।
সাহিত্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘কপালকুন্ডলা’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক রোমান্টিক উপন্যাস। সমাজ ও সংসারের অসংখ্য টানাপোড়েন আর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যার কাহিনী এগিয়েছে। ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসটি ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ মোট ১৪টি প্রবন্ধ নিয়ে লেখা বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যক্তিধর্মী প্রবন্ধ সংকলন। বাংলা সাহিত্যে কমলাকান্ত এক অভূতপূর্ব সৃষ্টি, অভিনব চরিত্র যে একাধারে কবি, দার্শনিক, ভাবুক, সমাজচিন্তাবিদ, ইতিহাসসন্ধানী, মানবপ্রেমিক, স্বদেশপ্রেমী, হাস্যরসিক, জীবনরসিক। ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু ছিল সমসাময়িক বাঙালি হিন্দু সমাজের দুটি প্রধান সমস্যা-বিধবাবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রথা।
অবশ্য একালে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে জীবন উপাদানের তুলনায় নীতি, ধর্মাদর্শ ও সম্প্রদায় গৌরবের প্রাধান্য সম্পর্কে অনুযোগ উঠেছে। কেউ কেউ তাঁকে অভিষিক্ত করেছেন সাহিত্য সম্রাটের শিরোপায়, আবার অনেকেই তাঁর কপালে এঁকে দিয়েছেন সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্ক-তিলক। আসলে আমার মনে হয় বঙ্কিমচন্দ্রের শিল্পকলায় তাঁর ব্যক্তি-হৃদয়ার্তি প্রতিফলিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বঙ্কিমচন্দ্রের পরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভা বাংলা সাহিত্যকে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ করেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ মূলত স্রষ্টা। সাহিত্যের প্রতিটি শাখা তাঁর অলৌকিক প্রতিভার স্পর্শে নবীনরূপ লাভ করেছে। যদিও কবিতা ও গান তাঁর নিজস্ব শাখা তবুও ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ শাখাতেও তিনি কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন।
তিনি তাঁর সাহিত্য জীবনে ১৩টি উপন্যাস রচনা করেছেন। বৌ-ঠাকুরাণীর হাট (১৮৮৩) তাঁর প্রথম উপন্যাস। এটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। সর্বাধিক আলোচিত সমালোচিত অন্যান্য উপন্যাসগুলো- চোখের বালি (১৯০৩), নৌকাডুবি (১৯০৬), গোরা (১৯০৯), ঘরে বাইরে (১৯১৬), শেষের কবিতা (১৯২৯)।
বাংলা উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণকান্তের উইলের পর বড় ধরনের পালাবদল হয় ‘চোখের বালি’তে৷ বালবিধবার চিত্তে পুরুষের প্রতি দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষার জাগরণ এবং তার মানসিক পরিবর্তনের টানাপোড়েন এই উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসটি অতি চিত্তাকর্ষক এবং জটিল নাটকীয় পারিবারিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে লিখা। ‘গোরা’ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের হিন্দু ও ব্রাহ্মসমাজের সংঘাত ও ভারতের তদানীন্তন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলি। ‘ঘরে বাইরে’ কবিগুরুর অতি তাৎপর্যপূর্ণ একটি উপন্যাস যার বিষয়বস্তু ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের জটিলতা।
রবীন্দ্রনাথের শেষ উপন্যাস ‘চার অধ্যায় (১৯৩৪)’ সমসাময়িক বিপ্লবী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একটি বিয়োগান্তক প্রেমের উপন্যাস।
১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য বাংলার এই সাহিত্যসম্রাট সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
বাঙালি সমাজ ও পারিবারিক জীবনের যুগসঞ্চিত সংস্কারে কবিগুরু যুতসই আঘাত দিয়েছিলেন তাঁর অসাধারণ সাহিত্য কর্মের মধ্য দিয়ে। গীতিকবির পক্ষে কঠোর বাস্তবতাকে অনুসরণ করে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মনোবিশ্লেষণ অত্যন্ত বিস্ময়কর। বাংলা উপন্যাসের মনোবিশ্লেষণমূলক রীতি রবীন্দ্রনাথের হাতেই সম্পূর্ণতা লাভ করেছে। বাংলা উপন্যাসের তখনও পর্যন্ত প্রচলিত ছক ভেঙে তিনি এগিয়েছেন তাঁর আপনরূপে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় সংস্কারমুক্তির যে পরিচয় মেলে তারই পূর্ণতার বিকাশ ঘটেছে শরৎ-সাহিত্যে।
তাঁর ঔপন্যাসিক খ্যাতি গড়ে উঠেছিল সমাজ ও নীতিঘটিত উপন্যাসে। নিন্দার শিকার হলেও প্রগতিবাদী নতুন অনেক লেখক ও পাঠকের প্রশংসাও পেয়েছিলেন তিনি। উপন্যাসে তিনি যেমন খুব চিত্তাকর্ষক কাহিনীর অবতারণা করেছিলেন, তেমনি সমাজের অনাচার এবং এর চাপে পিষ্ট মানুষের মর্মান্তিক পরিণতি আর তাদের প্রতিবাদের কাহিনি লিখে সমাজের শিষ্ট ও শিক্ষিত স্তরে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছিলেন।
শরৎচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস বড়দিদি (১৯১৩) প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যজগতে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। সর্বমোট ২৪টি উপন্যাসের রচয়িতা তিনি৷ সাহিত্যিক মহলে তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের খ্যাতি পায়- ‘শ্রীকান্ত (১৯১৭-১৯৩৩)’। চার খণ্ডে লেখা এই উপন্যাসটিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম আত্মকাহিনির ছলে লিখা উপন্যাস। ভ্রমণকাহিনি নির্ভর এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র-শ্রীকান্ত, যিনি জীবনের অভিজ্ঞতার বর্ণনার ছলে উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন বিচিত্র সব ঘটনার বর্ণনা ও অসংখ্য নরনারীর সমাবেশ। সেসব ঘটনা ও বহুল চরিত্রের মধ্যেও উপন্যাসের মূলসূত্র শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর প্রণয় কাহিনীর দিকে প্রবাহিত হয়েছে৷
অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে-দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), গৃহদাহ (১৯২০), দেনা-পাওনা (১৯২৩) এবং পথের দাবী (১৯২৬) খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ধারণা করা হয়, রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি'র আদর্শই শরৎচন্দ্রকে ‘চরিত্রহীন’ এর কিরণময়ী চরিত্রাঙ্কনে প্রেরণা দিয়েছিল। ‘দেবদাস’ সম্পূর্ণরূপে একটি প্রেম কাহিনী। যদিও এই গ্রন্থটি প্রত্যক্ষ কোন বার্তা প্রেরণ করে না, তবুও তৎকালীন ধনবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থার চাপে সদ্যযৌবনের প্রেমাবেগ কিভাবে সমাধিস্থ হল রূঢ় সমাজ ও মানবিক নিয়ম-নীতির কাছে তাই এই উপন্যাসের কাহিনি।
‘পথের দাবী’ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটি তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস। বিংশ শতাব্দীর এই উপন্যাসটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লেখা হয়। ১৯২৬ সালে উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হলে ব্রিটিশ সরকার এটি নিষিদ্ধ করেছিলেন। ‘পরিণীতা’ সমাজের কদর্য নিয়মনীতি থেকে বেরিয়ে এসে সমগ্র গ্রাম্য মহিলাদের পুনর্জাগরণের কাহিনি।
অপরাজেয় এই কথাশিল্পী সমাজের বঞ্চিত-লাঞ্ছিতদের জীবন অতিশয় গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। নিগৃহীত, প্রপীড়িতদের হৃদয়ে প্রবেশ করেছেন এবং তাদের হয়ে কথা বলেছেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
পল্লীর প্রকৃতির কথা স্মরণে বাঙালি পাঠক সমাজে প্রথম যার নামটি উচ্চারিত হয় তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। নরনারীর প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখ আশা আনন্দের আপাত তুচ্ছ কাহিনির সঙ্গে প্রকৃতির রসমাধুর্যের সমন্বয় সাধনে তিনি এক অসাধারণ কথাশিল্পী।
বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের পর বাংলা উপন্যাসের প্রবহমান ধারায় তিনি যুক্ত হন বিশ শতকের তিনের দশকের শুরুতে। তিনি মূলত উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯২৫ সালে তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ রচনা শুরু করেন। এর মাধ্যমেই তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এরপর ‘অপরাজিত (১৯৩১)’ রচনা করেন যা পথের পাঁচালীরই পরবর্তী অংশ। উভয় উপন্যাসেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর এই রচনাগুলোতে নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনচিত্র ও সমকালের আর্থসামাজিক বাস্তবতাও সমভাবে উন্মোচিত হয়েছে। তাই বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের পরে বিভূতিভূষণই সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সাহিত্যিকের মর্যাদা পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে।’
নিভৃতচারী এই কথাশিল্পীর রচনাসম্ভারের মধ্যে রয়েছে ১৪টি উপন্যাস। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আরণ্যক (১৯৩৯), আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০), ইছামতী (১৯৫০) ও অশনি সংকেত (১৯৫৯)।
‘আরণ্যক’ উপন্যাসে রহস্যময়ী মানুষ ও প্রকৃতিকে পৃথক স্বাধীন মাত্রা দিয়েছেন বিভূতিভূষণ। প্রকৃতির নিগূঢ় সত্তাকে উন্মোচিত করেছেন শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। তিনি জৈবিক মানবজীবনকেও এঁকেছেন একই ক্যানভাসে। প্রকৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্য দিয়ে তিনি গভীর জীবনদৃষ্টিকেও তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে। অনেক সাহিত্য বিশেষজ্ঞের মতে ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটি বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠ রচনা।
‘ইছামতী’ উপন্যাসের পটভূমি ইংরেজদের দুঃশাসন, সেই সময়কার গ্রামীণ জীবনের চিত্র, বিভিন্ন প্রথা, কুসংস্কার ইত্যাদি। উপন্যাসের বিশেষত্ব এটিই যে, এখানে ব্যতিক্রমীভাবে তুলে ধরা হয়েছে ইংরেজদের এ দেশীয় দোসরদের আর্থিক অবস্থা এবং ইংরেজদের বিদায়ে তাদের হাহাকার। ১৯৫১ সালে ইছামতী উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার রবীন্দ্র পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম জীবনে কিছু কবিতা লিখলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তারাশঙ্করের প্রধান খ্যাতি। বিশেষ করে তার রচিত ছোট গল্পগুলো একেকটি হীরকখণ্ডতুল্য৷ তবে এই সাহিত্যসাধকের জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাসগুলোই তাকে বাংলা সাহিত্যে অন্যতম মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
তারাশঙ্কর তাঁর প্রায় সব লেখায় মানুষের মহত্ত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন, যা তাঁর লেখার সবচেয়ে বড় গুণ। বিশেষভাবে তাঁর লিখায় বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের মানুষ, গ্রাম্য কবিয়াল সম্প্রদায়ের কথা পাওয়া যায়। মানুষের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ম অনুভূতিকে তিনি তাঁর লেখাতে এতটাই গভীরভাবে বর্ণনা করেছেন যে, পাঠকের পক্ষে তা হৃদয়ঙ্গম করা সহজ নয়।
তারাশঙ্কর সাহিত্য সাধনায় ব্রতী থাকাকালীন ৬৫টি উপন্যাস রচনা করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অন্যান্য উপন্যাস- রাইকমল (১৯৩৫) কবি (১৯৪৪), হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৫১), গণদেবতা (১৯৪৩) ও মন্বন্তর (১৯৪৪)।
‘কবি’ উপন্যাসটি তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের কালজয়ী সাহিত্যকর্ম। উপন্যাসটিতে তৎকালীন হিন্দু সমাজের রূপ ও আচার, জীবনসংগ্রাম, প্রেম ইত্যাদি বিষয়গুলোর জোরালো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সাহিত্যবোদ্ধাদের মতে, এটি তারাশঙ্করের অমর উপন্যাস, অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এতে পাওয়া যায় একজন কবিয়ালের মনের ভেতর জগতের সন্ধান। এই উপন্যাসের কবিয়ালের তার প্রেয়সীকে বলা একটি অত্যন্ত পাঠকপ্রিয় উক্তি- ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদো কেনে?/কালো চুলে রাঙা কুসুম হেরিছ কি নয়নে?’
এই কথাশিল্পীর অন্যতম আলোচিত উপন্যাস ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, যেখানে সমাজ ও রাজনীতি পরস্পরিত হয়ে বাংলার জীবন ও সংস্কৃতির সাথে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে। তারাশঙ্কর দেখাতে চেয়েছেন হাঁসুলী বাঁকের গোষ্ঠী জীবনের বিনাশের ইতিহাস, মূল্যবোধের বিপর্যয় এবং পরিণতিতে কাহার সম্প্রদায়ের স্বগ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়ার প্রসঙ্গ।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাসে- প্রেম, পরকীয়া, শৌখিনতা, বিলাসিতা, বৈরাগ্য, অবহেলা, প্রবঞ্চনা, দ্বন্দ্ব- সংঘাত, সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, ভাঙা-গড়ার কাহিনিই সৃষ্টি করেছেন নানা অনুষঙ্গে, নানা আঙ্গিকে, নানা ঘরানায়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
বাস্তববাদী ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশ শতকের ৩০এর দশকে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র ধারার বিরোধিতা করে যে কল্লোল গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে, সেই গোষ্ঠীর লেখক হিসেবে মানিকের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে ওঠে। মেহনতী সর্বহারা মানুষের জীবনের বাস্তব কাহিনীকে জীবন্ত করে তুলেছেন তিনি তার রচনায়, যার মধ্য দিয়েই তিনি বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বমোট ৪০টি উপন্যাস লিখেছেন। পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬) ও পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬) তার সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং শ্রেষ্ঠ দুটো উপন্যাস। এছাড়াও তিনি রচনা করেছেন অজস্র উপন্যাস ও গল্প। ব্যক্তিগতভাবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন মধ্যবিত্ত মানসিকতারই অধিকারী। তাঁর প্রথম উপন্যাস দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫) মধ্যবিত্ত জীবনভিত্তিক কাহিনি নিয়েই গড়ে উঠেছে। ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসে গুরুত্ব পেয়েছে পদ্মাপাড়ের মানুষের অন্তর্লোকের রহস্য, পদ্মানদীর মাঝিদের প্রত্যক্ষ বাস্তববোধ আর তাদের অসহায়তা, জীবনযন্ত্রণার আর্তি, প্রতিকূল সংগ্রাম।
‘পুতুল নাচের ইতিকথা’- জটিল সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে গড়ে উঠেছে এর কাহিনী ও প্রেক্ষাপট। এই সমাজ সংসারের স্রষ্টার হাতের পুতুল হিসেবে যদি আমরা নিজেকে কল্পনা করে থাকি, তাহলে আমাদের পরিণাম এবং ভাগ্য নির্ণয় করেন একমাত্র তিনি। আরেকভাবে ভাবলে মানুষ নিজের কৃতকর্মের দ্বারাই নিজের ভাগ্য ও জীবনকে পুতুল বানিয়ে তাকে নিয়ে ভয়ঙ্কর খেলা খেলে। উপন্যাসে এ সত্যই উচ্চকিত হয়েছে।
জননী (১৯৩৫) এক মমতাময়ী মায়ের গল্প যিনি সব প্রতিকূলতার পরও নিজের সন্তানদের আগলে রেখেছিল নিজের সব স্নেহ ভালোবাসার শক্তিতে। চতুষ্কোণ (১৯৪২) উপন্যাসটির ভিতরে রয়েছে সুক্ষ্ম মনোবিজ্ঞান যার রহস্য পাঠককেই বের করতে হয়৷
মনুষ্যত্ব ও মানবতাবাদের জয়গানই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যের মূল উপজীব্য। তবে বাংলা সাহিত্যকে উচ্চাসনে নিয়ে গেলেও তিনি তাঁর শেষ জীবন কাটিয়েছেন দারুণ অর্থকষ্টে। সমাজের শাসক ও পুঁজিপতিদের হাতে দরিদ্র সমাজের শোষণ-বঞ্চনার স্বরূপ তুলে ধরেছেন সাহিত্যের নানা চরিত্রের আড়ালে। বিপ্লবী এই লেখক সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজ সংসারের হাজারও চিত্র।
লেখক: লোকপ্রশাসন বিভাগ (৩য় বর্ষ), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
কুবি/মাহি